জন্মদিনে স্মরণঃ কে ন জি মি জো গু চি
বাবলু ভট্টাচার্য : জাপানি চলচ্চিত্রের কথা উঠলে আকিরা কুরোসাওয়ার নাম সবার আগে উঠে আসে। কিন্তু তাঁর জন্মের ঠিক এক যুগ আগে ১৮৯৮ সালে আরেক নির্মাতা কেনোজি মিজোগুচি জন্মেছেন, যাকে চিনতে বাকি পৃথিবীর সময় লেগেছে অনেকদিন।
যেসব জীবনের প্রতি পক্ষপাত ও দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে আবিষ্কারের দিকে নিয়ে গেছে, তা হলো মানুষের লাঞ্ছিত জীবন, যা কখনো যুদ্ধে, কখনো দারিদ্রে পর্যদুস্ত। বিশেষত নারী হয়ে উঠেছে ইস্পাতদৃঢ় এক সত্তা— মরতে হয়েছে, তবু টলাতে পারেনি— এমন।
মিজোগুচির চলচ্চিত্রের এই কদর শুরু হয় তাঁর মৃত্যুর এক দশক পরে। তাঁর অনেক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হলো, মিজোগুচি এবং তাঁর সহযোগেীদের অনেক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। মিজোগুচি যেন নতুনভাবে আবিষ্কৃত হলেন।
১৯৬৫ সালে তাঁকে নিয়ে বই লিখলেন বাঁজা গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত ফরাসি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক মাইকেল মেসনিল। সত্তর দশকের শেষদিক পর্যন্ত এই মিজোগুচি সংক্রান্ত প্রবল আলোচনা চলতে থাকে। এই সময়ে জাপানে যখন এই সব লেখাজোকার অনুবাদ বেরোতে থাকে তখন তাদের টনক নড়ে। তারা তাদেরই চলচ্চিত্রের আরেক দিকপালকে নতুনভাবে চিনতে থাকেন।
কেনজি মিজোগুচি চিত্রকলায় তাঁর একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে বিজ্ঞাপন বানানো শুরু করেন। এরপর তিনি অল্প কিছু দিন অভিনয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন। এর তিন বছরের মাথায় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
১৯২৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম আলোচিত চলচ্চিত্র ‘স্ট্রিট স্কেচ’। এরপর একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি নির্মাণ করেন প্রায় ৮৬টি চলচ্চিত্র। ১৯৫২, ৫৩ এবং ৫৪ সালে তাঁর নির্মিত ‘দ্য লাইফ অফ ওহারু’, ‘উগেতসু এবং ‘সানশো দ্য বেইলিফ’ সিনেমাগুলো ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে লেওনে দারজেন্তো তথা সিলভার লায়ন জিতে নেয়।
ডেভিড ব্রডওয়েল বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ বলেছেন ১৯৩০-এর দশকে নির্মিত মিজোগুচির চলচ্চিত্র, যেমন- ‘নানউইয়া ইলগি’ (১৯৩৬), ‘সিস্টারস অফ গিয়ন’ (১৯৩৬), ‘দ্য স্টোরি অফ লাস্ট ক্রিসান্থামাস’ (১৯৩৯), ‘জেনরিকো চুসিংগুরা’ (১৯৪১-৪২), ‘ওম্যান অফ দ্য নাইট’ (১৯৪৮) এবং ‘মাই লাভ হ্যাজ বিন বার্নিং’ (১৯৪৯)-এ তাঁকে ভিন্নমাত্রায় পাওয়া যায়।
মিজোগুচি মেলোড্রামার ব্যবহার করলেও তা ছিল অনেক সংযত। তিনি তাঁর অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই জাপানি কাবুকির বিষয় এবং রীতির সঙ্গে পশ্চিমা নৃত্যকলার মিশ্রণে জাপানে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে শিনপা নাট্য পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল তাকে ব্যবহার করেছেন। এই নাট্য পদ্ধতিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর যে নিপীড়ন, শোষণ এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়ার যে প্রবণতা সেটাই দেখানো হয়।
মিজোগুচির চলচ্চিত্রেও আমরা নারীর এই ভূমিকাকে দেখতে পাই। কিন্তু তাঁর চলচ্চিত্রের শেষে নারীকে খুব কম সময়েই বিজয়ী হতে দেখা যায়। আর তাঁর নারী চরিত্র জিতুক বা হারুক, কিন্তু ভিক্ষা চাইবে না বা কান্নাকাটি করবে না। নারীর শক্ত একটি ভাবমুর্তি তাঁর সিনেমায় দেখা যায়।
যেমন মিজোগুচির পপ্পি চলচ্চিত্রের দৃশ্যে দেখা যায় একজন বাবা এবং কন্যা নিশ্চিত হয় কন্যার স্বামী তাকে পরিত্যক্তা ঘোষণা করছে। তখন কন্যা তার বাবাকে সান্তনা দিচ্ছে এবং তারা আলিঙ্গনবদ্ধ হচ্ছে। অর্থাৎ নারী মানসিকভাবে শক্ত আছে।
এখানে কোনো ক্লোজআপ ব্যবহার করা হয়নি। কোনো দ্রুত কাটের ব্যবহার করা হয়নি। কোনো ক্যামেরা মুভমেন্ট নেই। মিজোগুচির এক-একটা শট ২৬ সেকেন্ড বা ৩০ সেকেন্ড, কখনো তা ১ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতো।
মিজোগুচি জাপানকে ছাপিয়ে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের কাতারে দাঁড়ানোর দাবিদার। যদিও কাইয়্যু দ্য সিনেমা মিজোগুচিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে, কিন্তু তিনি আসলেই বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক অনন্য স্রষ্টা।
ওজু বা কুরাশাওয়ার মতো জাপানি নিউ ওয়েভের আরেক সৃষ্টি কেনজি মিজোগুচি।
জাপানি বাস্তবতাবাদের অন্যতম জনক এই নির্মাতা ১৯৫৬ সালের ২৪ আগস্ট মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
কেনজি মিজোগুচি ১৮৯৮ সালের আজকের দিনে (১৬ মে) জাপানের হঙ্গো শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment