——–জন্মদিনে স্মরণঃ সন্তোষ কুমার ঘোষ——-
বাবলু ভট্টাচার্য : সন্তোষ কুমার ঘোষের পাণ্ডিত্য ও তার অনুভবী মনের পরিচয় বাংলার পাঠককুল বার বার পেয়েছেন তার লেখার মধ্যে দিয়ে। ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘শেষ নমস্কার’ উপন্যাস চিরাচরিত আখ্যান থেকে আলাদা যেমন ছিল, তেমনই সন্তোষ কুমার ঘোষ তার ছোটগল্পে অতি আধুনিক ছিলেন। পড়া এবং শেখা। পড়তে পড়তে শেখা । অমোঘ শব্দ চয়ন, অমোঘ বাক্য নির্মাণ, চরিত্রের অন্তঃস্থলে প্রবেশ এসব মিলিয়ে-মিশিয়েই সন্তোষ কুমার ঘোষের গল্প এবং উপন্যাস। আশ্চর্য সব গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন সন্তোষ কুমার ঘোষ। বাস্তব থেকে পরবাস্তবে প্রবেশ করে সমাজের হাড়-পাঁজরা দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘শেষ নমস্কার’সহ বহু কালজয়ী উপন্যাস ও গল্পের লেখক প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষ যখন আনন্দবাজার পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন সংবাদ প্রকাশের ধরণই তিনি পরিবর্তন ঘটাতে চাইলেন।
আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নিয়ে আসলেন বহু কবি-সাহিত্যিককে। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিদিনের সংবাদের ভাষাও হবে সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ। পাঠকরা একই সঙ্গে খবর ও কাব্যময় গদ্যের স্বাদ আস্বাদন করবেন। ধুতি, দামী সিল্কের পাঞ্জাবি আর জর্দা– সঙ্গে পান্ডিত্য ও অনুভবী মন৷ এই নিয়েই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষ৷ তিনি ছিলেন বাংলা সাংবাদিকতার Legendary figure. সংবাদ পরিবেশন এবং লিখনে এক নতুন ধারা এনেছিলেন তিনি৷ দেখার চোখ ছিল তাঁর অনন্য৷ পৈতৃক নিবাস ছিল বরিশাল৷ বাবা সুরেশচন্দ্র ঘোষ, মা সরযূবালা দেবী৷ সন্তোষ কুমার ১৯৪০ সালে distinction সহ বি.এ পাশ করেন৷ ১৯৪১ সালে ‘প্রত্যহ দৈনিক’-এ সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন৷ কিছুদিন পর স্টেটসম্যান পত্রিকায় যোগ দেন৷ ১৯৫১ সালে দিল্লী যান এবং হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় যোগ দেন৷ তিনি দ্য মর্নিং নিউজ এবং দ্য নিউ নেশন পত্রিকায় কাজ করেছেন৷
১৯৫৮ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় নিউজ এডিটর হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৬৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক এবং ১৯৭৬ সালে Joint Editor হন৷ সাংবাদিকতার সূত্রে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, কোরিয়া, পাকিস্তান, রাশিয়াসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। সন্তোষ কুমার ঘোষ নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস– সাহিত্যের সব শাখাতেই অনায়াস বিচরণ করেছেন৷ তাঁর প্রথম কবিতা ‘পৃথিবী’ প্রকাশিত হয় নবশক্তি পত্রিকায় ১৯৩৭ সালে৷ সে বছরেই প্রথম ছোটগল্প ‘বিলাতি ডাক’ প্রকাশিত হয় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায়৷ ১৯৫০ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘কিনু গোয়ালার গলি’। যা লেখক, পাঠক এবং সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ এরপর একে একে প্রকাশিত হয়– ‘নানা রঙের দিন’, ‘মোমের পুতুল’ (সুধার শহর), ‘মুখের রেখা’, ‘জল দাও’, ‘স্বয়ং নায়ক’, ‘শেষ নমস্কার : শ্রীচরণেষু মাকে৷’ দ্বিতীয় পুরুষে লেখা ‘রেনু তোমার মন’ বাংলা সাহিত্যে এক অসাধারণ সংযোজন৷ নাটক : ‘অপার্থিব’, ‘অজাতক’। সন্তোষ কুমার ছোটগল্পে ছিলেন অতি আধুনিক৷ ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘শেষ নমস্কার’ উপন্যাস চিরাচরিত আখ্যান থেকে আলাদা৷ স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭১ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৭২ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার৷
১৯৫০ এর ঠিক আগে পরের সময়ের অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারি আর সেই সময়ের গ্যাসবাতি জ্বলা পুরনো কলকাতা আর নগরজীবনকে তিনি যেভাবে ধরেছিলেন তাঁর গল্প- উপন্যাসে, তা ছিল সবার থেকে আলাদা৷ তাঁর তুলনা তিনিই৷ সন্তোষ কুমারের কলমের ধার খুব৷ আঁচড়ে আঁচড়ে তিনি বেআব্রু জীবনকে চিনিয়ে দিতে পারতেন৷ ভিতর ও বাইরের কলুষতাকে খুঁজে বের করে দিতেন৷
১৯৮৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোকগমন করেন।
সন্তোষ কুমার ঘোষ ১৯২০ সালের আজকের দিনে (৯সেপ্টে) বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment