বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, কোন ছোট্ট বেলায় তাঁর কটকটে কথায় অবাক হয়ে নেতাজি নাম দিয়েছিলেন ‘কটকটি’। নজরুলের কাছে গান শিখতে গেছেন। রেকর্ড করবেন। কিছুক্ষণ রিহার্সালের পর নজরুল বললেন- ‘‘আগে ‘র’ আর ‘ড়’-এর উচ্চারণ ঠিক করে এসো, তবে গান।’’ সেই যে চলে এলেন, জীবনে আর নজরুল গীতি গাইলেন না। তাঁর এই অভিমানে কিন্তু মজা পেয়েছিলেন নজরুল। আদর করে ডাকতেন ‘বিশাখা’। উচ্চারণে দোষ আছে বলায় নজরুলের কাছ থেকে চলে এসেছিলেন। কিন্তু দিব্যি মেনে নিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিককে। ’৪৪ সাল। ছবির নাম ‘মেরি বহেন’। ‘ম্যায় ইন ফুলো সাঙ্গ’ গানের রিহার্সাল হচ্ছে। সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বহু চেষ্টা করেও পুর্ব বাংলার মেয়ে উৎপলাকে দিয়ে ‘চন্দ্রবিন্দু’র উচ্চারণ করাতে পারছেন না। শেষে উৎপলার নাক চিপে ধরে ভুল শোধরালেন।
এর পরও কিন্তু পঙ্কজ মল্লিক বলতে অজ্ঞান ছিলেন তাঁর ‘মৃণাল’ (এই নামেই ডাকতেন উৎপলাকে)। ‘নাগিন’ রিলিজ করেছে। ’৫৪-’৫৫ সাল হবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন মুম্বইয়ের বাসিন্দা। আশা ভোঁসলের গানের ভক্ত উৎপলা হেমন্তর কাছে গায়িকার ছবি চেয়ে পাঠালেন। উপায়ান্তর না দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্বয়ং আশার কাছেই ছবি চাইলেন। ছবি দিলেন বটে, কিন্তু উৎপলা সেনের মতো গায়িকার এমন আব্দারে প্রায় আকাশ থেকে পড়েন আশা ভোঁসলে। এর পর তো সময়ের ফেরে আশাজির সঙ্গে খুব আলাপ জমে যায় উৎপলারও। কলকাতায় এলে কড়েয়া রোডে তাঁর বাড়িতে আসতেনই আসতেন আশাজি। এক বার কোনও কারণে আসতে পারেননি। তড়িঘড়ি ফিরে যেতে হয়েছে মুম্বই। খবর পেয়ে এতটাই অভিমানী হয়ে পড়েছিলেন উৎপলা, বহু দিন ধরে আগলে রাখা আশার সেই ছবি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলেন। কথাটা কানে গিয়েছিল আশার। পরের বার দেখা করে নতুন একটা ছবি দিয়ে মান ভাঙাতে হয়েছিল তাঁকে। অথচ এই মানুষই যখন হারমোনিয়াম ধরতেন, মুগ্ধ হতেন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সরোজিনী নাইডুর মতো মানুষজনও। রানি এলিজাবেথ ভারতে এলে সরোজিনী নাইডু উৎপলাকে ডেকে গান শোনাতে বলেন। তাতে রানিও মুগ্ধ। পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল থাকার সময় পদ্মজা নাইডু তো গভর্নর হাউসের একটা ঘরই ছেড়ে রেখেছিলেন। গার্স্টিন প্লেসের আকাশবাণী ভবন থেকে গান করে মাঝপথে উৎপলা যাতে বিশ্রাম নিতে পারেন। ঢাকার সার্ক অধিবেশনে ওসমানি মিলনাতয়নে প্রেসিডেন্ট এরশাদের অনুরোধে উৎপলা সেখানেই গাইতে ডাক পান। ’৯১ সাল। উৎপলার ইন্টেস্টিনাল ভলভুলাস ধরা পড়ল। জটিল রোগ।
অপারেশন হল। ওই সময় থেকেই খুব দুশ্চিন্তা করতেন সতীনাথ। কী যে হল তাঁর প্রাণভোমরা রোশনির! সম্পর্ক তো এক-আধ বছরের নয়, উৎপলা যখন বেণু সেনের ঘরণি, তখন থেকে। তিন জনের বন্ধুতা, হৃদ্যতা কখনও যে টাল খায়নি একটি বারের জন্যও। ১৯৬৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেণু সেনের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর মায়েরই উদ্যোগে সতীনাথ বিয়ে করেন উৎপলাকে। তার পর জীবন চলেছে নানা বাঁক পেরিয়ে। হঠাৎ একটা অঘোষিত টাইফুন কোত্থেকে ধেয়ে এসে সব যেন উপড়ে ফেলে দিল।২০০০ সালে কোলন ক্যানসার হল উৎপলার। আবার অপারেশন। বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু দিনে দিনে বন্দি হয়ে পড়লেন বিছানায়। তবু শুয়ে শুয়েই ঘরকন্নার তদারকি করতেন। আর শেষের বছরটা জড়িয়ে বাঁচতেন সদ্যোজাত নাতিকে নিয়ে। নামও রাখলেন নিজেই— সূর্য। ওই অতটুকু শিশুর কানে সুর ঢেলে দিতেন যখনতখন! ২০০৫ সালে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে কোমার মধ্যেই চলে গেলেন ক্যানসারে আক্রান্ত উৎপলা সেন।
উৎপলা সেন ১৯২৪ সালের ১২ই মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment