ভাস্কর ভট্টাচার্য: কলকাতা,১৩এপ্রিল ২০২০। বৈশাখ দিয়ে শুরু চড়ক দিয়ে শেষ। বাঙালি জীবনে ধর্মী আচার অনুষ্ঠানের অন্ত নেই। কিন্তু এ বছর সেখানেও কোনো দোলা নেই, গাজন তলায় কোনো বাজনা নেই। নেই সন্ন্যাসী র সমাগম। অধিক সন্ন্যাসী তে গাজন নষ্ট হবার কোনো ভয় নেই। তার থেকে বড় ভয় ঘিরে রয়েছে আমাদের জীবনে। মেলা নেই, চড়ুকে হাসি নেই। সুতানুটির সিমলে পাড়ায় গাজন বা চড়ক উৎসব নেই। যেখানে সন্ন্যাসীরা গোটা চৈত্র মাস বাবা চরণের সেবা লাগে মহাদেব এই সুরে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে চাল আলু কলা সংগ্রহ করে সন্ধে বেলায় গঙ্গা য় হব্যিষ্যি ভক্ষণ করে কৃচ্ছ্রসাধন সাধন করে চড়ক চড়ক পাক খেয়ে উপস্থিত আমুদে দর্শকদের আমোদ বিতরণ করে ব্রত সমাপন করেন।
এ বছর কোথাও হয়নি শিবের গাওন, শিবের ভজন।
কোথায় ঢাকা ঢোল কাঁসি নিয়ে শিবের মতোই ভিক্ষুক বেশে ভিক্ষা পাত্র সড়া হাতে কোনো গেরুয়া ধারীর দেখা মেলেনি। চড়কের একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে। সে পথ আমরা যাব না। তবে এই চড়ক বা গাজন উৎসবকে ঘিরে কী বিপুল উন্মাদনা তার ছবি আঁকা আছে হুতোম প্যাঁচার নকশায়। অতীতের কলকাতায় এই চড়ক উপলক্ষে বের হত সঙ। জেলে পাড়ার সঙ্ অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতাব্দীর এক উল্লেখযোগ্য সামাজিক চিত্র। হুতোম ভাষায় এই সঙ দেবার জন্য গোটা চিৎপুর লোকারণ্য হয়ে যেত। তবে মূল কথা কেউ কেউ বলেন ধর্ম ঠাকুরের মধ্য দিয়েই এসেছে। আবার কেউ বৌদ্ধ থেকে আগত বলেন। আবার হিন্দু দের মধ্যে চড়ক বাণ রাজার শিব তপস্যা বলে কথিত।
চলুন আমরা দেখি কেমন ছিল সুতানুটি র চড়ক। কলকাতায় বাগবাজারে র রামধন ঘোষের ষোল চড়ক সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল। তা বাদ দিয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “সুতানুটি র ছাতু বাবুর মাঠে চড়ক গাছ ছিল আকর্ষণীয়। এখানে নাকি বাণ না ফুঁড়ে চড়ক গাছে ঘোরানো হত। ”
চড়ক নানা দাঁতের কথা শোনা যায়, ঝুল, ঝাঁপ বঁটি ঝাঁপ, আগুন ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ। তিনি নানা ধরণের ফোঁড়া। লোহার গরম শিক দিয়ে পিঠ বা জিভ ফুঁড়ে সন্ন্যাসী প্রমাণ করতেন, তাঁর সাধন কত সিদ্ধ। যদিও নৃশংস তার কারণে সরকার থেকে সে সময়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সবই অতীতের চর্বিত চর্বন।
তবু বাঙালি জীবনে গাজন দিয়ে একটা বছর শেষ হয়। নীলকণ্ঠ শিবের নীলের উপোষ ও শিবের গাজন দিয়ে বাঙালির একটা অংশ একটা বছর পার করে, হাতে তুলে নেয় হালখাতা ও নতুন পাঁজি। পাঁজি অনুযায়ী বাংলা ক্যালেন্ডার। সারা বছর ইংরেজি মতে চললেও বাংলা ক্যালেন্ডারেই লেখা থাকে বাঙালির তিথি নকশার বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন সহ শুভ অশুভ অনুষ্ঠান। এ বছর বাঙালি পাঁজি পেলেও গাজনের বাজনা শুনতে পেলেন না। করোনা ভাইরাসের খবরে চক্ষু চড়ক গাছ। সঙ্গের ছবি মিসেস বেলনের আঁকা। সেও এক বাঙালির ইতিহাস। যিনি বাঙালি জীবনের “হোলি” “নাচ গার্ল “, চড়ক’, প্রভৃতির ছবি এঁকেছিলেন।
Be First to Comment