Press "Enter" to skip to content

করোনা ভাইরাস রুখতে হোমিওপ্যাথি কি কার্যকর?১০এপ্রিল হোমিওপ্যাথির জনক হ্যানিম্যানের ২৬৫ তম জন্মদিনের প্রাক্কালে কি বললেন হোমিও চিকিৎসক ডা:প্রকাশ মল্লিক…..

Spread the love

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা, ৫ এপ্রিল ২০২০ করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে বিশ্ব জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে। সংক্রমণ এবং লাফিয়ে বাড়া মৃত্যু তো বটেই, মানুষের ভীতির অন্যতম কারণ এই ভাইরাস ঘটিত রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয় নি। এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় মূলত ইনফ্লুইয়েঞ্জা রোগের এবং নিউমোনিয়া রোগের ওষুধ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। স্বস্তির কথা, চিকিৎসকেরা এই চিকিৎসায় সফল হচ্ছে। প্রথমে বলা হচ্ছিল, যেহেতু বয়স্ক মানুষদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, সেহেতু সংক্রমিত হওয়ার বিপদ তাঁদের বেশি। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাস সার্স বা মার্স এর মত প্রাণঘাতী না হলেও অনেক বেশি সংক্রামক। ফলে রোগটি এখন মহামারীর স্তর পেরিয়ে অতিমারী হয়ে উঠেছে। চীনে এই রোগ যখন প্রবল, তখন নতুন বছরে জানুয়ারি মাসে দেশের আয়ুশ মন্ত্রক এর অধীনস্থ বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা পর্ষদের সঙ্গে সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারদের এক বৈঠক হয়। পরে আয়ুশ দফতর থেকে এক বিবৃতি জারি করে বলা হয়, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে হোমিওপ্যাথি ও ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর। দেশে মার্চ মাসের শুরুতে যখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে লাগলো তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো একটি খবর। করোনা ভাইরাসের হোমিওপ্যাথি ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে। চলতি চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরা বিষয়টিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। সমালোচনার ঝড় উঠলো।আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও পারেনি, সেখানে হোমিওপ্যাথির মত একটি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ওষুধ আবিষ্কার গল্প। বাস্তব নয়। এই ওষুধ মানুষকে আরও বিপদে ঠেলে দেবে। এই বিতর্ক যখন চরমে উঠলো এই প্রতিবেদক হাজির হয় বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডা:প্রকাশ মল্লিকের কাছে। উদ্দেশ্য একটি সাক্ষাৎকার।দীর্ঘ ৩৭বছর ধরে ডা: মল্লিক শুধু এদেশেই নয়,বাংলাদেশেও জনপ্রিয়। ১

৯৯৫-৯৬সালে ইন্টারন্যাশানাল ম্যান অফ দি ইয়ার নির্বাচিত হয়েছেন। মার্কিন মুলুক থেকে এই সম্মান তিনি পেয়েছেন ২০০০-২০০১সালে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ওপর তার লেখা বই আছে প্রায় ৭০টি। চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদকও তিনি।
প্রশ্ন: ডা:মল্লিক করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি । সেই প্রেক্ষিতে হোমিওপ্যাথি ওষুধ কাজ দিচ্ছে বলে আপনারা দাবি করছেন। কিন্তু চলতি এলোপ্যাথি চিকিৎসকেরা মানতে রাজি নন। কি বলবেন?
ডা:মল্লিক: হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে আজ নয়, শুরু থেকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চলছে। হোমিওপ্যাথি যদি কাজ না করতো তাহলে এলোপ্যাথিতে কাজ না পেয়ে আমাদের কাছে আসেন কেন? তার মানে এই নয়, যে হোমিওপ্যাথিতে সব রোগ সারে। এলোপ্যাথিতেও সব রোগ সারে না। আমি কখনও এলোপ্যাথিকে প্রতিপক্ষ ভাবী না। উদ্দেশ্য রোগমুক্তি। রামকৃষ্ণদেব তো বলে গেছেন, যত মত, তত পথ।আমার বেশ মনে আছে কিংবদন্তি হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ডাঃ ভোলানাথ চক্রবর্তীকে বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সরোজ গুপ্ত বলেছিলেন হোমিও চিকিৎসা ক্রিমিনাল অফেন্স। আচ্ছা, সরোজ বাবুরা কি বলতে পারবেন বুকে হাত দিয়ে, সব ক্যান্সার রোগীদের তাঁরা সুস্থ করে দিতে পারেন? পারেন না, চেষ্টা করেন। আমরাও চেষ্টা করি। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, কোনও ক্যান্সার রোগীকে যদি পাঁচটা বছর বেদনাহীন ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেটাই সাফল্য। আমরা কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে ক্যান্সার রোগীদের যন্ত্রণা মুক্ত রাখতে পারি। ভুলে গেলে চলবে কেন, একসময় পুড়ে গেলে জল লাগাতে বারণ করা হত। কিন্তু আজ বলা হয়, পুড়ে গেলে জল দিতে। হোমিওপ্যাথিতে ন্যানো পার্টিক্যাল এর গুরুত্ব আছে। আমরা ওষুধের সূক্ষ স্তরের পর্যায় এ আস্থা রাখি। যা নিয়ে এলোপ্যাথি চিকিৎসকেরা হাসি মস্করা করেন। বলেন, হরিদ্বারে হোমিও ওষুধ ফেললে গঙ্গায় যা মিলবে। কিন্তু তাঁরা জানেন না, টাটা আই আই টি থেকে একটি গবেষণা হয় । যেখানে বলা হয়, সমুদ্রে এক ফোঁটা কালি ফেললে দেখা যায় না, তার মানে এই নয়, যে সমুদ্রে কালির মলিকিউল নেই। আমরা দেশে যখন কলেরা মহামারীর আকার নেয়, তখন উপসর্গ ছিল ডাইরিয়া। তাই লক্ষণ দেখে আর্সেনিক ৩০ প্রয়োগ করলাম। বেশ কাজ দিল। হোমিওপ্যাথির জনক হ্যানিম্যান সাহেব বলেছিলেন, মহামারী বা অতিমারীতে লক্ষণ দেখে চিকিৎসায় জেনাস পিডো মিক্যালস থিওরি। যা রোগের লক্ষণ এর গড় ধরে ওষুধ নির্বাচন করা হয়। করোনা মূলত একটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এক্ষেত্রেও লক্ষণ দেখে ওষুধ নির্বাচন আমরা করেছি। আমি যদি বলি পৃথিবীতে অনেকবার মহামারীর দেখা দিয়েছে, তবু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দাবিদার রা কেন এখনও ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারলেন না। এই দায় কি বর্তায় না?

প্রশ্ন: এলোপ্যাথি চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেন, এমন কিছু অসুখ আছে যার ওষুধ দরকার হয় না। সময়ের বিনিময়ে সেরে যায়। সেক্ষেত্রে হোমিও চিকিৎসায় চিনির গুলিতে রোগ সেরে যাওয়া আসলে প্ল্যাসিবো চিকিৎসা।
ডা:মল্লিক: তর্কের খাতিরে যদি মেনে নিই, হোমিও চিকিৎসা প্ল্যাসিবো ,তাতে ক্ষতি কি? আড়াইশ বছরের হোমিওপ্যাথি এবং আমার ৩৭বছরের অভিজ্ঞতা বলছে , প্ল্যাসিবোতে যদি ৭৫ শতাংশ রোগ সারে, তাতে যদি সাইকোলজিক্যাল রিলিফ মেলে তাতে ক্ষতি কি? তাছাড়া হোমিওপ্যাথিতে টিউমার, আঁচিল সেরে যাওয়াটা কি প্ল্যাসিবো ?আধুনিক চিকিৎসার দাবিদার রা আজকাল হাড় ভাঙ্গা রোগীদের শুধু লোকাল আনেস্থেশিয়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথের আকাশ ভরা সূর্য তারা বা আলোকের এই ঝর্ণাধারায় গান বাজিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন। রাগাশ্রয়ী গান বাজিয়ে বাইপাস সার্জারি করছেন। এটাও কি প্ল্যাসিবো? হরমোনের ক্ষরণে মিউজিকের একটা ভূমিকা আছে এটাকে কি বলবেন ?
প্রশ্ন: একটা ব্যাপার বলুন, মার্কস সাহেব জার্মানির মানুষ। সেখানে মার্কসবাদ ব্রাত্য, হ্যানিম্যান সাহেবও জার্মানির মানুষ। সেখানে তিনিও ব্রাত্য।
ডা: মল্লিক: ঠিকই বলেছেন, কিন্তু মনে রাখবেন কিছুদিন পর্যন্ত জার্মানি থেকে আসতো হোমিও ওষুধ। ক্রমে তা বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে বহুজাতিক এলোপ্যাথি ওষুধ কোম্পানির চক্রান্ত।দেখবেন, মদের দোকানে লাইন পড়ে। দুধের দোকানে নয়। নিমপাতা একটি অ্যান্টিসেপটিক । আমরা কি তা ঠিকমত কাজে লাগাচ্ছি? চিকিৎসার কাজে আমাকে প্রায়ই বাংলাদেশে যেতে হয়। সেখানে এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, জল,আর বড়ি দিয়ে কি রোগ সারে?আমি বললাম, পৃথিবীর অনেক দেশেই ভাত খায়না। তার মানে কি ভাত পৌষ্টিক আহার নয়? দুঃখের কথা, সীতার মতো আজও আমাদের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়, ঠিক যেভাবে সক্রেটিস, গ্যালিলিও, ব্রুনো কে দিতে হয়েছিল ।
প্রশ্ন: কিন্তু একথা তো মানবেন, হ্যানিম্যানের অনেক স্ববিরোধী কথা আপনাদের বিরোধীদের সুযোগ করে দিয়েছে হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে কথা বলার। আপনি জানেন, ১৮২০সালে পেলেটিয়ে, ক্যাভেনটো সঙ্কোনা গাছের ছালের নির্যাস থেকে ম্যালেরিয়া চিকিৎসার কার্যকরী উপাদান কুইনিনকে পৃথক করতে সক্ষম হন। যা চিকিৎসায় সফল হয়। হ্যানিম্যান কিন্তু এটা নির্বুদ্ধিতা বলেছিলেন। পরে সাফল্য দেখে বলেন, এই কুইনিন উপকারের চেয়ে বেশি অপকারই করে। ১৮১২ সালে সম্রাট নেপোলিয়ানের সেনা বাহিনীতে টাইফাস রোগ হলে হ্যানিম্যানকে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হয়। কিছুটা সাফল্যে কিছু অনুগামীও মেলে। কিন্তু বহেমিয়ার রাজকুমার সোয়াতসেনবারগ হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় মারা গেলে বিরোধীরা আবার জোর কদমে বিরোধিতায় নেমে পড়ে। পরবর্তী সময়ে হ্যানিম্যানের অনুগামী অনেকে হ্যানিম্যানের অনেক বক্তব্যে সহমত না হয়ে বিরোধিতা করেন। ১৮২৮ সালে হ্যানিম্যান তাঁর দি ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থে বলেন, অধিকাংশ রোগের পেছনে সোরা বা খোসপাঁচড়া দায়ী। অনেক হোমিওপ্যাথরা তা মেনে নিতে পারেননি।
ডা: মল্লিক: ঠিকই বলেছেন, হ্যানিম্যান সাহেব তাঁর ডাক্তারি জীবনে মোট ছ বার মত বদলেছেন। সঠিক বিজ্ঞানের এই তো নিয়ম। এতো ধর্মগ্রন্থ নয় যে শাস্ত্রে যা লেখা তা অখন্ডনীয়। বিজ্ঞানীর ভুল প্রমাণিত হলে বুঝতে হয় বিজ্ঞান এগোচ্ছে। আইনস্টাইনের যদি কোনো ভুল আগামী দিনে প্রমাণিত হয়, তাতে কি বিজ্ঞানী হিসেবে কি আইনস্টাইনের যোগ্যতা অস্বীকার করা যায়? বিদেশে ভুল হলেও কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের পুরস্কৃত করা হয়। বিধান রায়ের নাম আমরা জানি। কেননা উনি যশ খ্যাতি পেয়েছিলেন, কিন্তু আমরা কজন বিধান রায়ের শিক্ষকের নাম জানি? আসলে পুঁথিগত শিক্ষা নয়, চিকিৎসায় দরকার পর্যবেক্ষণ। বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত।
প্রশ্ন: সবশেষে একটা প্রশ্ন, হোমিওপ্যাথিক ফার্মা কো পিয়ায় imponderabilia অর্থাৎ যা মাপা যায় না বলে একটা বিভাগ আছে। যা নাকি আজগুবি তত্ত্বে ঠাসা। এমন অভিযোগ। কেননা সুগার অফ মিল্ক বা জলে এক্স- রে রশ্মি বিদ্যুতের শক্তি, চুম্বকের শক্তি, কড়া রোদের শক্তি বা চাঁদের জোছনার শক্তি মিশিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় হ্যানিম্যান চুম্বকের দুই মেরু থেকে দুটি হোমিওপ্যাথি ওষুধ বানিয়েছিলেন। উত্তর মেরু থেকে megnetis polus Articus ও দক্ষিণ মেরুর সাহায্যে Magneris polus Australis । এই বিষয়গুলি হোমিওপ্যাথি বিরোধীরা রূপকথার গল্প বলেন। আপনি কি বলবেন?
ডা: দেখুন, এই অভিযোগ পুরনো। প্রকৃতির কিছু শক্তি আছে। হোমিওপ্যাথ সেটাই বলে। যাকে বলে ন্যাচারোপ্যাথি। অনেক আমাদের তরল ওষুধ স্ট্রোক করে খাওয়াতে বিদ্রুপ করেন। কিন্তু জলের বোতল নাড়িয়ে দিলে জল উথলে পড়ে। এটা কোন শক্তি? ঘর্ষণে একটা শক্তি উৎপন্ন হয়। জলে যে আলোড়ন হয় সেটাই তো শক্তি। আমরা কি জানি না, পাথরে পাথরে ঘর্ষণে আগুন জ্বলে ওঠে । আগুন আবিষ্কারের সেই প্রথম সূত্র।
তবে এটা ঠিক, কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নয়। হোমিওপ্যথিও তাই। দরকার দৈনন্দিন গবেষণা।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.