রণবীর ভট্টাচার্য: কলকাতা, ১৬মে ২০২০।করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অসীম লড়াইয়ে আজ রক্তাক্ত সারা পৃথিবী। প্রতিটি দেশ তার নিজের মত করে লড়াই করে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি এবং দেশীয় বাজার অর্থনীতি এক অভূতপূর্ব ধাঁধার মুখোমুখি। এতদিনে দেশের প্রতিটি মানুষ জেনেছেন কি ভীষণ বিপদে পড়েছেন আমাদের দেশের খেটে খাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা। কাজ না করলে পেট ভরবেনা, এই মর্মান্তিক নিয়মের ফাঁসে আটকে তারা। চতুর্থ দফার লক ডাউন হবে কিনা, দেশের ভাগ্য-বিধাতারা ছাড়া কেউ জানেন না। এই অবস্থায় অনেকেই নিজের রাজ্যে ফেরার জন্যে রওনা দিয়েছেন। কয়েক শো মাইল তো বটেই, হাজারের উপর মাইল পাড়ি দিয়েছেন অনেকেই। কিছু ভাগ্যবান শ্রমিক বিশেষ শ্রমিক ট্রেনে ফিরছেন আর বাকিরা বাসে আর বেশীরভাগই হেঁটে। সাইকেলে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য গিয়েছেন, এরকম উদাহরণও নেহাত কম নয়। অনেকে বাড়ি ফেরার আগেই ট্রেনে কাটা পড়ে ও দুর্ঘটনায় লুটিয়ে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে; রাস্তায় প্রসব যন্ত্রনা হয়েছে, অভুক্ত অবস্থায় রাস্তায় বসে পড়েছেন – অজস্র ছবি এরকম ইন্টারনেটে, খবরের কাগজে, টিভিতে দেখেছি আমরা। কিন্তু কেন এমন হল? জনতা কারফিউ একটি ইঙ্গিত ছিল, কিন্তু লকডাউন ঘোষণা ছিল কিছুটা আকস্মিক, অন্তত সেই সমস্ত মানুষদের কাছে যাদের স্মার্ট ফোন নেই, পড়াশোনা কম জানেন বা নিতান্তই মজুরি খাটেন। রাতারাতি কাজ বন্ধ, রোজগার বন্ধ এবং স্বল্প জমানো টাকা শেষ হলে – খাওয়া বন্ধ। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের তরফে যখন রেশনের কথা বলা হল, তখন অনেকেই আশ্বস্ত হলেন। মুশকিল হল বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিকের কাছেই রেশন কার্ড নেই বা থাকলেও গ্রামের বাড়িতে রয়েছে। বলা হল যে প্রতিটি রাজ্য সরকার তাদের দায়িত্ব নেবে। এরই মধ্যে গুজব রটল, কিছু স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতা সহানুভূতি পাওয়ার স্বার্থে ভুল পথে চালিত করলেন এই মানুষদের। দিল্লী বা মুম্বই এর সেই দৃশ্য এখনও সবার মনে আছে, কিভাবে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক স্রেফ চোখে জল নিয়ে অপেক্ষা করছেন বাড়ি ফিরবেন কি করে ভেবে। রাজ্যকে আবার দায়িত্ব দেওয়া হল কিন্তু এরা তো কেউ কাজের জায়গায় ভোটার নয়। তাই খাতির হল না, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি উঠল বেশি। পরবর্তীকালে অনেক রাজ্য বাস পাঠিয়ে ফিরিয়ে আনল, ট্রেন চালু হলে অনেক মানুষেরা ফেরার সুযোগ পেলেন। কিন্তু বিপদ যা হওয়ার তো হয়েই গিয়েছে! করোনা কি আর কাউকে রেয়াত করে? অনেক পরিযায়ী শ্রমিকও শিকার হয়েছেন এই ভয়ানক আগ্রাসী ভাইরাসের।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার দাবি কি যথাযথ? ওনারা কি থেকে যেতে পারেন না? যদি আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়েন, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কি হবে? বাড়ির লোক তো বলবেনই, নিজেও ভাববেন যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে। তাই মানবতার দিক থেকে ভাবলে বলাই যায়, পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরতে চেয়ে ভুল দাবি করেননি। প্রশ্ন উঠছে যে বিদেশ থেকে যদি মানুষকে প্লেনে ফেরত আনা যায় তাহলে পরিযায়ী শ্রমিকদের আনার ক্ষেত্রে তৎপরতা দেখানো যায় না কেন? এই প্রশ্নটি শুনতে খুব তেতো হলেও বাস্তবিক বলাই চলে। সমস্যার শেষ এখানেই নয়। আমাদের দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের কোন তথ্যসমৃদ্ধ ডাটাবেস নেই। ধরে নেওয়া যাক, ‘ক’ জায়গা থেকে এক শ্রমিক ‘খ’ জায়গায় এসে পৌঁছেছেন। ‘ক’ জায়গায় তিনি গয়না শিল্পের কাজ করতেন কিন্তু তার নিজের গ্রাম ‘খ’ জায়গায় গয়না শিল্পের কোন কাজ হয় না। তাই যতদিন না অবধি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সেই শ্রমিক কিন্তু কোন কাজের জায়গায় নেই। এখানেই সমস্যা, যদি তথ্যসমৃদ্ধ ডাটাবেস থাকত তাহলে নিজের রাজ্যে কাজের ক্ষেত্রে সুবিধা হতে পারত। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হল, পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি বড় সংখ্যা সেই অর্থে সংগঠিত সেক্টরে কাজ করেন না। তার ফলে করোনা পরবর্তী পর্বে তাদের কাজের দিকটি অনিশ্চিত।
এই মুহূর্তে যা অবস্থা, একশ দিনের কাজ শুরু হলেও দেশের সমস্ত জায়গায় কাজ শুরু হওয়া সম্ভব নয়। খাদ্য সুরক্ষার দিকটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে এই সময়ে। টাকা ছাপানো উচিত কি নয়, সেই সিদ্ধান্ত সরকারের, কিন্তু এটিও সত্যি যে এই গরিব পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে অর্থের জোগান এই মুহূর্তে বেশ কম। শহরের ক্ষেত্রেও কিন্তু পরিস্থিতি আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের হাতে সরাসরি টাকা তুলে দেওয়ার কথা নিয়ে অনেক বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রস্তাব দিয়েছেন কিন্তু সেটা কতদিন সম্ভব তাও ভেবে দেখার মতো। সরকারকে কি কাজ তৈরি করার দায়িত্ব নিতে হবে? ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে বাস্তব হল, সরকারকে এই কাজ তৈরির কর্মকান্ডে নিযুক্ত থাকতেই হবে। এই করোনা পর্ব বেশ কিছু দিক আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোকে সামনের দিনে মাথায় রাখতে হবে। শ্রমিক আইনের সংস্কার, শ্রমিক স্বার্থে খাদ্য- স্বাস্থ্য-রোজগারের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়ার আশু প্রয়োজন। ভুললে চলবে না, যারা তথাকথিত ভাবে অনেক বিত্তশালী, তারা কারখানায় কাজ করেন না, মাঠেও চাষ করেন না।
এই শ্রমিকদের শ্রম কিন্তু তাদের অর্থের প্রাচুর্য এনে দিয়েছে। যদি এই সত্য উপলব্ধি করতে পারেন সমাজের সমস্ত ধনসম্পদশালী মানুষ, তাহলে দেশের পরিযায়ী শ্রমিক শুধু নয়, সমস্ত শ্রমিকের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে।
Be First to Comment