মধুমিতা শাস্ত্রী, ১৩ এপ্রিল, ২০২০।
‘ও ভোলা মন,
মিছে শুনিসনে বারণ
শিব ঠাকুরের চরণতলে
জীবন করগে সমর্পণ।’
হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গানের সুরে নিজের কথা বসিয়ে ঢোল, খঞ্জনী বাজিয়ে গাইতে গাইতে একদল লোক হই হই করে চলে এল বাড়ির দরজায়। সবার পরনে গেরুয়া রঙে ছোপানো কাপড়, গলায় উত্তরীয়। একজন আবার নকল বাঘছাল পরে আর জটা মাথায় চাপিয়ে শিব সেজেছে। বাড়ির আঙিনায় খানিকক্ষণ নেচে-গেয়ে তারপর বড়িয়ে দিল ভিক্ষার ঝুলি। মুখে আওয়াজ– বাবা মহাদেবের চরণের সেবা লাগি…….বাবা মহাদেব।
নাঃ এদৃশ্য এবছর দেখা যায়নি। কারণ, করোনা মহামারী। কিন্তু প্রত্যেক বছর চৈত্র মাসের মাঝামাঝি এ হল গ্রামবাংলার অতি পরিচিত এক দৃশ্য। সন্ন্যাসী বেশে এই লোকগুলি অন্য সময় নানা পেশা অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ চাষ করে, কেউ মাছ ধরে, কেউবা রিকশ চালায়। কিন্তু গোটা চৈত্রমাস এরা সন্ন্যাসী হয়ে দোরে দোরে ভিক্ষা করে খায়। যা শেষ হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন বা চড়ক বা শিবপুজোর মধ্যেদিয়ে।
কোথাও আবার এই পুজোকে ধর্মঠাকুরের পুজোও বলা হয়। আদতে এই পুজো বা উৎসব হল বাংলা ও আশপাশের বেশকিছু রাজ্যের লোকউৎসব। এই উৎসবগুলো আদতে মানুষের প্রাচীন জীবিকার সঙ্গে জড়িত। চৈত্র সংক্রান্তির পরই নতুন ফসল তোলা হয় মাঠ থেকে। তার আগে সাধারণত গ্রামের মানুষের হাতে কোনও কাজ থাকে না। নতুন ফসল যাতে জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি বয়ে আনে তারই কামনা করে মানুষ শিবঠাকুরের পুজো করে। চৈত্র সংক্রান্তি অর্থৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে গ্রামে গ্রামে পুজো, মেলা, উৎসব হয়। একটি লম্বা কাঠ গোটা বছর একটি পবিত্র পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়।
সন্ন্যাসীরা পুজোর আগে সেটি তুলে মাঠে পোঁতে। এই কাষ্ঠ দন্ডটিই দেবতা হিসেবে পূজিত হয়। সন্ন্যাসীরা ওই দন্ডের মাথায় নিজেকে বেঁধে চড়কির মতো ঘোরে। অনেক সময় বঁড়শি দিয়ে পিঠের চামড়া ফুঁড়ে সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে ঝুলে পড়ে। এ হল নিজেকে কষ্ট দিয়ে দেবতাকে তুষ্ট করার প্রাচীন পদ্ধতি। চড়কের পুজোকে কেন্দ্র করে মাঠ জুড়ে মেলা বসে যায়। নানা মনিহারি জিনিষ, খেলনা, খাবার দাবার, গানের আসর বসে। ইদানীং অবশ্য এই মেলা গুলির চরিত্র অনেকটা পাল্টেছে।অনেক আধুনিক হয়েছে। অনেক জয়গায় মেলাতে ঘোড়দৌড়, লাঠিখেলা ইত্যাদিও হতে দেখা যায়। বসে জুয়ার আসরও। তবে এবছর কোথাওই বাংলার এই প্রাচীন লোক সংস্কৃতির ঝলক আমাদের চোখে পড়বে না। আশায় থাকি, ‘আসছে বছর আবার হবে’।
Be First to Comment