রণবীর ভট্টাচার্য: কলকাতা,১৪মে ২০২০। মৃত্যুর পর এটাই ওনার দ্বিতীয় জন্মদিন। দুই দিন আগে ওনার অমর সৃষ্টি ‘ভুবন সোম’ এর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। তবে মৃণাল সেন আজকের দিনে থাকলে হয়তো ভবানীপুরের বাড়ির ল্যান্ড লাইনে অনেক ফোন আসত, কিছু সাক্ষাৎকারের অনুরোধ থাকত বা রঙিন পাতাও- কিন্তু একবার হলেও বলতেন করোনা যুগের আকালের সন্ধানের কথা। বর্তমানে মারণ করোনাভাইরাসের দরুণ দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পরিযায়ী শ্রমিকের দল কোথাও হেঁটে চলেছে বা কোথাও ট্রেনের কামরায় দুর্দান্ত গতির কাছে ফেলে যাচ্ছে নিজের রোজগার, উপার্জন আর ভবিষ্যৎ কিংবা ট্রেনের লাইনে পড়ে থাকে বাসি রুটির টুকরো – ঠিক যেন মৃণাল সেনের সিনেমার কোন চরিত্রের মত।
সাদা কালো সিনেমার জাদুকর মৃণাল সেনের সিনেমায় গল্পই ছিল রাজা আর সেই গল্প আবর্তিত হত সামাজিক বাস্তবতা ঘিরে। অনেকেই বলেন যে নিজের বামপন্থী সত্ত্বা বারবার যেন তার সিনেমায় উঠে এসেছে। কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, মৃণাল সেন ছিলেন আপাদমস্তক সমাজবিপ্লবী। ফারাক এই, তার কোন ঢাল – তলোয়ার ছিল না, বা রূপকের কোন আবেশ নিয়েও সিনেমাকে বুদ্ধিজীবী-শ্রেণী সুলভ করার অকারণ চেষ্টা করেননি। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই বলা যায়, সমসাময়িক দুই শিল্পী সহযোদ্ধা সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিলেন তিনি।
প্রবাদই রয়েছে শিল্পীরা বেঁচে থাকেন তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে। এই অস্থির সময়ে, যখন বেঁচে থাকাটা কঠিনই নয়, বরং কঠিন চ্যালেঞ্জ, তখন বারবার যেন আপামর বিশ্বের সকল সিনেমাপ্রেমী মানুষের কাছে মৃণাল সেনের এক একটি সিনেমা মানবতার জীবন্ত দলিল হয়ে দেখা দেয়। হলফ করে বলা যায়, উনি বেঁচে থাকলে নিজে শেষবারের মত গর্জে উঠতেন এই নাম, ঠিকানা হারিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে।
সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন – দুজনেই নিজের মত করে কলকাতা ট্রিলজি বানিয়ে ছিলেন, যা চিরকালের জন্য সমসাময়িক। কিন্তু এখন কোভিড আক্রান্ত সাধের কলকাতাকে নিয়ে কি বানাতেন? প্রাণের শহর কলকাতা এখন বিধ্বস্ত, চারিদিকে বৈপরিত্য, গুজব আর মৃত্যুর হাতছানি। স্কুল, কলেজ কবে খুলবে জানা নেই, অফিস পাড়া সেই যে ঘুমিয়েছে তারপর আর ওঠেনি।
হাসপাতালমুখো হতে মানুষ ভীত ও সন্ত্রস্ত। এই অবস্থায় খুব দরকার ছিল মৃণাল সেনের মতো মানুষের, যিনি আরো একবার আশার কথা শোনাতে পারতেন সমাজের মেহনতী মানুষদের – নতুন কোন ভুবন সোম আর গৌরীর চলার পথ নিয়ে।
Be First to Comment