মধুমিতা শাস্ত্রী, ২৪ মে, ২০২০ঃ দীর্ঘদিন জরাজীর্ণ দশায় ক্যানিং শহরের বুকে দাঁড়িয়ে ছিল বৃটিশ শাসক লর্ড ক্যানিং-এর বাড়ি হিসেবে পরিচিত প্রাচীন ইমারতটি। লোকে ক্যানিংয়ে এলে এই বাড়িটি দেখতে আসত। স্থানীয় মানুষের মুখে ঘুরতো নানা গল্প। বাড়িটির সামনে নাকি ফাঁসি দেওয়া হতো। ক্যানিংয়ের ভূতও নাকি দেখা দিত। এইসব। প্রচণ্ড শক্তিশালী উমপুন মুছে দিল সেই স্মৃতিচিহ্নটি। ভেঙে পড়ল পুরনো বাড়িটির বৃহদাংশ।
লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ি হিসেবে পরিচিত হলেও ইতিহাস বলছে, লর্ড ক্যানিং এখানে কখনও আসেননি। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর ক্যানিং মনোনিবেশ করেছিলেন নানা প্রশাসনিক সংস্কারের কাজে। প্রশাসনিক কাজে যাতে ভারতীয়দের অন্তর্ভূক্ত করা যায় সে জন্য বিল এনেছিলেন। এই সময়ে তৎকালীন বণিকসভা কলকাতা বন্দরের বিকল্প একটি বন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকারের কাছে আর্জি জানায়। ক্যানিংও সেই আর্জিতে সায় দেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল নতুন বন্দরটি হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুরের সমতুল্য। সেইমতো জায়গা খোঁজা শুরু হয় এবং সুন্দরবনের মাতলা ও বিদ্যাধরীর সঙ্গমের কাছে জায়গা বাছা হয়।
ঠিক ছিল ২০টি জেটি হবে। প্রতি জেটিতে ২টি করে জাহাজ দাঁড়ানোর বন্দোবস্ত থাকবে। থাকবে নদীর পাড় ধরে ট্রামওয়ে। যাতে চাপিয়ে মাল নিয়ে আসা হবে ট্রেন স্টেশনে। তৈরি হয় শিয়ালদহ থেকে একমুখী ট্রেন লাইন। শিয়ালদহ থেকে আসা ট্রেনটি একটি বৃত্তাকার চক্কর ঘুরে ফের উল্টোদিকে ছুটত। এই গোল চক্করটি কয়েকবছর আগেও ছিল। সেই অনুসারে এলাকাটির নাম এখনও গোলকুঠি পাড়া। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের নামে এই প্রোজেক্টের নাম হয় পোর্ট ক্যানিং। পোর্ট ক্যানিং প্রজেক্টের জন্য ৮ হাজার একর ও সাড়ে ছ’শো একর জমি দু লপ্তে নেওয়া হয়। তারমধ্যে কিছুটা চাষজমি ও বাকিটা জঙ্গল। ১৮৬১ সাল থেকে চালু হয় পোর্ট ক্যানিং। চালু হয় ক্যানিং মিউনিসিপালিটি। শুরু হয় জাহাজ আসা যাওয়া। কিন্তু শুরু থেকেই নানা বাধা বিপত্তি আসতে থাকে। দুর্ঘটনার কবলে পড়তে থাকে জাহাজ। সরকারও পোর্ট ক্যানিংয়ের প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে। বন্ধ হয় সরকারি অর্থ। বলা হয় কোম্পানি তৈরি করে শেয়ার বেচে টাকা তুলতে। এগিয়ে আসে ফার্দিনান্দ শিলার নামে এক ব্যক্তি। এই লোকটি কোম্পানি তৈরি করে বাজারে শেয়ার ছাড়েন। বেশ দামও ওঠে শেয়ারের। সেটি ১৯৬৪ সাল। এদিকে হেনরি পিডিংটন নামে এক আবহাওয়াবিদ শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, এই এলাকা বন্দর স্থাপনের অনুপযুক্ত।
কারণ ঝড়ের প্রকোপ। তাঁর কথায় কেউ কান দেয়নি। ১৯৬৭ সালে এই পিডিংটনের কথাই ফলে গেল। এল এক সাংঘাতিক ঝড়। ইংলিশম্যান কাগজের রিপোর্টে সেই ঝড়ের ভয়াবহতা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ঝড় শেষ করে দিয়েছিল পোর্ট ক্যানিংকে। আর এত বছর বাদে উমপুন ঝড় শেষ করে দিল পোর্ট ক্যানিংয়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন, যা সম্ভবত শিলারের কোম্পানির কোনও কাছারি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
Be First to Comment