স্মরণঃ সু র মা ঘ ট ক
বাবলু ভট্টাচার্য : ঋত্বিক যদি আগুনের নাম হয়, তবে নিঃসন্দেহে সে আগুন আগলে যিনি রেখেছিলেন তিনি সুরমা ঘটক। পরিচয়ের নিরিখে তিনি ঋত্বিক পত্নী। তবে শুধু কি তাই! সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পুরোধা কি হতে পারতেন ঋত্বিক, যদি না পাশে থাকতেন সুরমা! ইতিহাস সাক্ষী, তা কখনোই সম্ভব হত না।
বাস্তবিক অর্থে বলতে হয় ঋত্বিকের চালিকাশক্তি ছিলেন সুরমা ঘটক। উত্তাল সময়ে যখন নিজের রাজনৈতিক আদর্শে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছেন ঋত্বিক, চলচ্চিত্র নিয়ে নিজস্ব ভাবনা ও নীরিক্ষায় যখন বুঁদ, তখন একান্ত সহচরী হয়েই পাশে ছিলেন সুরমা।
গনগনে আগুন ঋত্বিকের সহধর্মিণী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! সুরমা আক্ষরিক অর্থে ছিলেন তাই।
এই ঋত্বিক একবারই প্রেমে পড়েছিলেন। আর সেই পদ্মের মতো প্রেমটি নিয়ে এসেছিলেন যিনি, তিনিই সুরমা ঘটক। ঋত্বিক ডাকতেন তাঁকে ‘লক্ষ্মী’ বলে।
শিলং পাহাড়ের মেয়ে সুরমা। বাংলা ভাগ হয়ে দুই টুকরো হওয়ায় ঢাকার সন্তান ঋত্বিক তখন কলকাতায়। ঋত্বিকের বর্ণনায়, কাগজের বাবুরা তাদের নাম দিয়েছিল উদ্বাস্তু- শরণার্থী। ঋত্বিকের জীবনে শরণার্থী কথাটা শ্লেষ হয়ে কানে বাজত।
সুরমা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ঋত্বিকও তাই। পার্টির সাংস্কৃতিক সংঘ গণনাট্য (আইপিটিএ) করতে গিয়ে পরিচয় দুজনের। উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে নিজের লেখা নাটক ‘দলিল’ বোম্বেতে মঞ্চস্থ করতে গিয়েছিলেন ঋত্বিক। সেখানে সুরমা ভিড়ের মধ্যে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করে দিয়েছিলেন। তার জন্য রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে এলেন। সেই পরিচয়ের শুরু। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল কলকাতায় ফিরে।
গণনাট্য সংঘে ঋত্বিক, সুরমাদের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। লেনিন, মার্ক্স, প্লেখানভ পড়াতেন মন্ত্রোচ্চারণকারী ঋত্বিকের মতো ভঙ্গিতে। সুরমা সে মন্ত্রে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। তিনি যে সাধারণ নারী নন। এর আগে কমিউনিস্ট পার্টির জন্য জেল খেটেছেন ১৮ মাস। সেসব লিখে গেছেন ‘শিলং জেলের ডায়েরি’তে। ‘বিসর্জন’ নাটকের মহড়া করাচ্ছিলেন ঋত্বিক। সুরমা করছিলেন ‘অপর্ণা’র রোল। দুটি চোখ এক হলো। দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গেলেন তখনই।
ঋত্বিকের পাগলামি, ঋত্বিকের ধর্মকে আপন করে নিয়েছিলেন শুধু নয়, সাংসারিক পরিসর থেকে মুক্তি দিয়ে ঋত্বিককে হয়ে ওঠার অবকাশও দিয়েছিলেন তিনিই।
সাংস্কৃতিক উথালপাথালে ঋত্বিক যদি শিখা হন তবে অবশ্যই সলতে পাকানোর কাজ আজীবন করে গিয়েছেন সুরমা ঘটকই। সুরমা সত্যিই যেন এক নদীর নাম। যে নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ঋত্বিকের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। পাশাপাশি কিছু সমালোচনাও আছে। তবে যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত তো মিথ্যে নয়।
১৯২৬ সালের ১৪ নভেম্বর সুরমা দেবী শিলং-এ জন্মগ্রহণ করেন। লিখেছেন বেশ কিছু বই। ‘শিলং জেলের ডায়েরি’, ‘পদ্মা থেকে তিতাস’, ‘ঋত্বিক’- পাঠকদের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছে।
সুরমা ঘটক ২০১৮সালের আজকের দিনে (৮ মে) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment