গোপাল দেবনাথ:৩১শে জানুয়ারি ২০২০ ডিজিটাল ইন্ডিয়ার আড়ালে এক গ্রামীণ ভারত লুকিয়ে আছে । শহুরে প্রগতির পাশে দেশের ভূমিপুত্র রা আজও বেমানান। সরকারি পরিসংখ্যানে ও বিজ্ঞাপনে আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলি হরিজন পংক্তিতে।
কিছু মানুষ আছেন যারা দেশের মূল সুরের স্পন্দনকে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চান। রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত এমনই এক জেলা পুরুলিয়া। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের চর্চা আছে।
কিন্তু পুরুলিয়ার মানভূমে ৮৭% বাঙালি ১৯৩১ এ বাংলা ভাষার যে আন্দোলন করেন সেই কথা আজ কেউ জানেনা। গণদাবিতে ১৯৫৬ তে ১ নভেম্বর পুরুলিয়া বাংলার অন্তর্ভুক্তি হয়।
পুরুলিয়ায় আদিবাসীদের দুটি গোষ্ঠী উল্লেখনীয়। সাঁওতাল এবং করমালি। ঐতিহাসিকভাবে দুটি ভাষাই মুন্ডারি খেরওয়াড়ী ভাষা। দুটি ভাষাতে মিল প্রচুর। সাঁওতালিতে মিত বার য়া কড়া হপনকিন তাঁহে কান তায়া। করমালিতে মিৎ হড় রেন বারয়া কড়া হপন তাঁহিকানাকিন। তবে কর মালিরা আদি অস্ট্রাল গোষ্ঠী র আদিবাসী আর সাঁওতালদের প্রটো অস্ট্রাল য়েড গোষ্ঠী থেকে উদ্ভব।
এদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। ক্ষয়িষ্ণু জাতি হিসেবে ক্রমশ আদিবাসীরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি সহযোগিতা নিয়ে কিছু বেসরকারি সমাজসেবী সংস্থা এগিয়ে এসেছেন ।বিশ্বজনীন সমাজ নির্মাণে অগ্রণী আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নেয়। বৃহস্পতিবার কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে এমনই এক অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের মূল সমাজের সঙ্গে জুড়তে কমিউনিটি রেডিওর গুরুত্ব সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরা হয়।
পুরুলিয়ার আদিবাসী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে আধুনিক সমাজের প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা হয়। সঙ্গে কৃষিবিকাশের উপযোগী তথ্য আবহাওয়ার খবর পাশাপাশি আদিবাসী সংস্কৃতিকে ব্যবহারিক জীবনের অঙ্গ করে তুলতে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।
প্রতিদিন বর্তমানে ১৬ ঘন্টা রেডিও সম্প্রচারের ব্যবস্থা রয়েছে। ডিজিটাল ভারতের এমন অনেক গ্রাম আছে যেখানে ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ এখনও পৌঁছোয়নি। সেক্ষেত্রে ব্যাটারি চালিত কমিউনিটি রেডিওর জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। পশ্চিমবঙ্গও এই তালিকায় আছে।অনুষ্ঠানে বিস্তারিত জানালেন ইউনিসেফের পশ্চিমবঙ্গের প্রধান সচিব মহম্মদ মহিউদ্দিন। এই কর্মযজ্ঞে সহযোগিতা করছে মানভূম আনন্দ আশ্রম নিত্যানন্দ ট্রাস্ট। এই কর্মযজ্ঞের শুরু ২০১০ সালে। ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচশ ঘণ্টার অনুষ্ঠান কমিউনিটি রেডিওতে প্রচারের জন্য অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। অনুষ্ঠান সৃষ্টিতে আদিবাসীরা নিজেরাই অংশ নেন।
রাজ্য প্রশাসনের পক্ষে হাজির ছিলেন শিশু অধিকার বিভাগের নোডাল অফিসার ভাস্কর চক্রবর্তী। দেশের কমিউনিটি রেডিওর পথিকৃৎ দেবারুন দত্ত, সমাজসেবী নির্মাল্য মুখার্জি, সিধু কানু বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদীপ্ত গুই প্রমুখ। নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য হাজির ছিলেন উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান,এবং ওড়িশার প্রতিনিধিরা।
ভাস্কর চক্রবর্তী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ৩০ বছর আগে রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামে আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম ,সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে আদিবাসীদের জোড়াটা কোনো ম্যাজিকে সম্ভব নয়।
শিক্ষার অভাবে এবং প্রাচীন সামাজিক ক্ষতিকর রীতিনীতি থেকে আদিবাসী সমাজকে মুক্ত চিন্তার মানুষ করে তুলতে তাঁদের সঙ্গে মিশতে হবে। এখনও নাবালিকাদের বিয়ে শিশু নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ক্ষতিকারক রীতিনীতি ত্যাগ করার কথা আদিবাসী সমাজ বুঝতে শিখছে।
ইউনিসেফের পক্ষে মৌমিতা দস্তিদার অভিজ্ঞতা আদানপ্রদানের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, কমিউনিটি রেডিওর পরিধি অনেক বেড়েছে।
কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনেও শোনা যাচ্ছে কমিউনিটি রেডিওর অনুষ্ঠান।
পুরুলিয়ার এই উদ্যোগ ধীরে ধীরে রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে পৌঁছে যাবে তার একটি উজ্জ্বল রেখাচিত্র ফুটে উঠলো এই অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ইউনিসেফের কমুনিকেশন ফর ডেভলপমেন্ট স্পেশালিস্ট নাসির আতিক, ‘মান্ট’ এর ডিরেক্টর ডঃ নির্মাল্য মুখার্জী, আহমেদাবাদের ‘দৃষ্টি’ সংস্থার ডিরেক্টর দেবারুন দত্ত এবং উপস্থিত আধিকারীকরা।
কমিউনিটি রেডিওর ভলান্টিয়াররা তাদের রেডিও সম্পর্কে কর্মক্ষেত্রে নানা সুবিধা ও অসুবিধার কথা উপস্থিত সাংবাদিক ও বাইরের রাজ্যের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনে এই রেডিও স্টেশনের উপর একটি সুদৃশ্য পুস্তক প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়াও এই রেডিও স্টেশনের উপর একটি সুন্দর তথ্য চিত্র দেখানো হয়েছে। তথ্য সহযোগিতায়- সুজিত চট্টোপাধ্যায়।
Be First to Comment