#নিজেকে গ্রহণ করার সাহসিকতায় কোনও তাৎপর্য নেই, একটি আত্মহত্যা পরিবেশকে ও হত্যা করে।#
মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ৭জুন, ২০২০। জীবনের বেশিরভাগ সময় রঙের আঁচড়ে কাগজের পাতা রঙীন করে তুললেও নিজের জীবন কে শেষ করে দেওয়ার আগে তিনি লিখেছিলেন “দুঃখ সবসময় টিকে থাকবে”- ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, নিজেকে হনন করেছিলেন, যার আক্ষরিক নাম আত্মহত্যা। আ্যডলফ হিটলার ও শত্রুদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে নিজের স্ত্রী কে নিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। আসলে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যা র চেষ্টা করা বিভিন্ন বিষয়ের সম্মিলিত জটিল পরিস্থিতি যা একে অপরের সাথে জড়িত। আত্মহত্যা বা আত্মহনন যা ইংরেজি ভাষায় ‘Suicide’ হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া।
ল্যাটিন ভাষায় সুইসেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে। যার অর্থ নিজেকে হত্যা করা। প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে সারা বছর যে সব কারণে মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশ তম কারন। কিশোর কিশোরী থেকে শুরু করে পয়ত্রিশ বছরের কম বয়সি মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। পুরুষদের আত্মহত্যার প্রবনতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুন অধিক। আত্মহত্যার কারন সমূহ বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন, আত্মহত্যা কারির মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার বা সেরাটোনিনের মাত্রা কম থাকে।
আত্মহত্যার প্রবনতা ও শারীরিক সমস্যার এক গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রয়েছে। তার সাথে মানসিক ভারসাম্য হীনতা, নেশাগ্ৰস্ততা, জুয়া খেলায় ব্যার্থতা আত্মহত্যার কারন হিসেবে ধরা হয়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বাইরে, চলতি সময়ের প্রেক্ষাপট বলছে, আত্মহত্যা আমাদের সমাজে প্রায় ডাল-ভাত এ পরিণত হয়েছে। প্রেমে ব্যর্থতা,মনমতো চাকরি না পাওয়া, পরকীয়া, স্বামী স্ত্রীর নিত্য কলহ, পরীক্ষায় মনমতো ফল না হওয়া, মায়ের বকুনি, বাবার শাসন, অভাব, জীবনের অপ্রাপ্তি, এমন কি মোবাইল ফোন সহ পুজোয় মনমতো পোশাক না পাওয়ার কারণে, বন্ধু র সাথে ঝগড়ার মতন সামান্য ব্যাপারে আত্মহত্যা করে বসে। এই সবকিছু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই একটা জায়গাতে আমরা হেরে যাই। তা হলো অভিমান আবেগ, জ্ঞান বুদ্ধিহীন বিচার ক্ষমতা। আমরা সকলেই জানি আত্মহত্যা মহাপাপ, এটা জেনে বুঝেও আত্মহত্যা করেন, কারন বেঁচে থাকা যখন অসহনীয় মনে হয়, তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না, তখন প্রবাহমান নিত্য যন্ত্রনা গুলো থেকে মুক্তির আশায় মৃত্যুকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয়। একজন মানুষ যখন মনে করেন বেঁচে থাকার সমস্ত উপকরণ হারিয়ে ফেলেছেন, তার অনুপস্থিতিতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না, তখনই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তার এই অভিমান ঠিক না ভুল তা বিচার করার ক্ষমতা থাকে না।
আবার জীবনের কঠিন মূহুর্তগুলি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে, পারিবারিক সাহায্যর অভাবে, একাই নিজের জীবনের সমাপ্তি টানতে এই পথ বেছে নেন। অপর একটি সূক্ষ্ম কারন, মানুষকে সহজেই আত্মহননের পথে ঠেলে দেয় তা হলো নিঃসঙ্গতা। মনের ক্ষত বা অবসাদের কথা ব্যক্ত করার মতো সহৃদয় সঙ্গী খুঁজে না পাওয়া, ধীরে ধীরে সেই ক্ষতই একসময় পুরোসত্তা কে গ্ৰাস করে। মানসিক ভাবে ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা থাকে না বলেই, আত্মহত্যা। অথচ, আত্মহত্যা যে কখনোই কাম্য নয় তা প্রাচীন ইতিহাস এ দেখতে পাই, প্রাচীন এথেন্স এ যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনূমোদন ছাড়া আত্মহত্যা করতো, তাহলে তাকে সর্বসাধারণের কবরস্থানের সম্মান দেওয়া হত না। প্রাচীন রোমে, আত্মহত্যা কে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ বলে মনে করা হতো। দার্শনিক আ্যরিষ্টটল ও আত্মহত্যা কে সমর্থন করেন নি। বর্তমান রাষ্ট্র ও সমর্থন করে না। তবুও আত্মহত্যা অব্যাহত। সমাজ অন্তর্গত প্রত্যেক মানুষ কে বুঝতে হবে, কঠিন পরিস্থিতি জীবনে যে কোনো সময়ে আসতে পারে। তাকে সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করাই বুদ্ধিদীপ্ত কাজ। জীবনের যে কোনো সংকটে বন্ধু বা পরিবারের সাথে কথা বলুন। বিফ্রেন্ডার নামে র স্বেচ্ছাসেবক দের সাথে কথা বলতে পারেন, ই-মেইল করতে, পৃথিবীজুড়ে এদের কাজ আপনার সমস্যা কে সমাধান করা। জীবনের অঙ্ক যে জটিল নয়, তাকে সরল করে ভাবতে সাহায্য করবে।
জীবন যুদ্ধে যে হেরে যায়, পৃথিবী তাকে মনে রাখে না। আত্মহত্যাকে কখনও যৌক্তিক বলে মনে করে না। জীবন ওয়ান ওয়ে রোডের মতো, সামনে এগোনো যায়, পিছনে ফিরে যাওয়ার মধ্যে কোনও সার্থকতা নেই। সৃজিত মুখোপাধ্যায় এর ‘হেমলক সোসাইটি’ চলচ্চিত্র টি র কথা মনে পড়ে যায়। আত্মহত্যা প্রবন ব্যাক্তি কে কিভাবে মানসিক দৃঢ়তা তৈরী তে সাহায্য করে সেই ধ্বংসাত্মক পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যায়, তার গল্পই বলেছিল। তাই মৃত্যু ও যেন তাৎপর্য পূর্ণ হয়, আত্মহত্যা কখনো নয়।
Be First to Comment