Press "Enter" to skip to content

আট বছরের মাতঙ্গিনীর সাথে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে হল। মাতঙ্গিনী ছিল কাদম্বরীর পূর্বনাম…..।

Spread the love

স্মরণঃ কা দ ম্ব রী দে বী

বাবলু ভট্টাচার্য : কাদম্বরীর সাথে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়েতে দাদা সত্যেন্দ্রনাথের তীব্র আপত্তি ছিল। কারণ, তাঁদেরই বাড়ির কাজের লোকের মেয়ে কি-না বউ হয়ে তাঁদেরই বাড়িতে আসবে! শোনা যায়, কাদম্বরীর দাদা একসময় কাদম্বরীর বাবা ও কাকার সাথে ঠাকুরবাড়ির আশ্রিত ছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছায় সব সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রেখে আট বছরের মাতঙ্গিনীর সাথে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে হল। মাতঙ্গিনী ছিল কাদম্বরীর পূর্বনাম। ঠাকুরবাড়িতে বউদের পূর্বনাম বদলে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল দীর্ঘদিনের। ধীরে ধীরে ‘মাতঙ্গিনী’ হারিয়ে গেল ‘কাদম্বরী’-র মধ্যে।

কাদম্বরী বউ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে যে বছর প্রবেশ করেন, ঠাকুরবাড়ির সে বছরের হিসেবের খাতা থেকে জানা যায়, কাদম্বরীর জন্য বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ কেনা হয়েছিল তাঁর পড়াশোনার জন্য।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে কিছুটা গোঁড়া ও রক্ষণশীল ছিলেন। পরে দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ও বৌদি জ্ঞানদানন্দিনীর প্রভাবে প্রাচীনপন্থী সংস্কার ত্যাগ করেন, হয়ে ওঠেন কলকাতার আধুনিক বাবু।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরীকে ঘোড়ায় চড়া শেখালেন। গঙ্গার ধারে নির্জনে চলত তালিম। শিক্ষা শেষ হলে প্রতিদিন তাঁরা স্বামী-স্ত্রীতে দুজন মিলে গড়ের মাঠে ঘোড়ায় চড়ে হাওয়া খেতে বের হতেন। সে সময় কাদম্বরীর ঘোড়ায় চড়ে স্বামীর সাথে হাওয়া খেতে বের হওয়া রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল কলকাতার রক্ষণশীল সমাজে।

কাদম্বরীর মধ্যে ছিল এক চিরন্তন মাতৃহৃদয়। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে দেখাশোনা করতেন। কারো জ্বর হলে শিয়রে কাদম্বরী, বাচ্চাদের কিছু সমস্যা হলে সাথে সাথে ছুটতেন কাদম্বরী। যেখানে ‘ঠাকুরবাড়িতে আদর ছিল নিছক বিনোদনমাত্র’। সদ্য মাতৃহারা দেবর ছোট্ট বালক রবিকেও তিনি পরম স্নেহে তাঁর কাছে টেনে নিয়েছিলেন, অথচ কতই বা বয়স তখন কাদম্বরীর! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে বড়- জোর এক কি দেড় বছরের বড়।

রবি ঠাকুর ও তাঁর নতুন বৌঠানের যে সম্পর্ক ছিল স্নেহের- মায়ার, সেই সম্পর্ক অনেক গবেষকের কল্পনায় সমবয়সি হওয়ার কারণে হয়ে উঠল পরকীয়ার। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ তো এই পরকীয়াকে পরোক্ষভাবে কাদম্বরীর আত্মহত্যার কারণ বলে প্রতিষ্ঠা অবধি করে দিলেন।

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের যা কিছু সুন্দর, তার সব কিছুর সাথে জড়িয়ে রয়েছেন কাদম্বরী। তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এসে তিনতলার ছাদে গড়ে তুললেন “নন্দন কানন”। পিল্পের উপর বসানো হল সারি সারি পাম গাছ। আশেপাশে গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা ফুলের গাছ। তার সাথে এল হরেক রকম পাখি।

ঘর সাজানোর দিকে প্রথম থেকেই কাদম্বরীর দৃষ্টি ছিল প্রখর। দেখতে দেখতে ঠাকুরবাড়ির চেহারা তিনি পালটে দিলেন।

ঠাকুরবাড়ির ছাদে কাদম্বরীর সাজানো বাগানে সন্ধ্যাবেলায় বসত গানের আসর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্রনাথ ধরতেন গান। কাদম্বরী নিজেও ভালো গায়িকা ছিলেন। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্রী তিনি, গান ছিল তাঁর রক্তে।

কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ি আসার পর তিনতলায় এল পিয়ানো। শুধু তাই নয়, কাদম্বরীর উৎসাহে ঠাকুরবাড়ির ছাদে বসত সাহিত্যপাঠের আসর। যে আসরে যোগ দিতেন বাড়ির অনেকেই। আর বাইরে থেকে আসতেন সাহিত্যিক অক্ষয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী। আর মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্ণকুমারী ছিলেন এই সভার স্থায়ী সদস্য।

কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী’র কবিতা কাদম্বরী খুব পছন্দ করতেন। এই বিহারীলাল ছিলেন রবিঠাকুরের কাব্যগুরু, ‘ভোরের পাখি’। কাদম্বরী, বিহারীলালের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একখানি আসনও বুনে উপহার দিয়েছিলেন।

কাদম্বরীর ছিল বইয়ের নেশা। তবে নিছক সময় কাটাবার জন্য তিনি বই পড়তেন না। বই পড়ে সেগুলোকে উপভোগ করতেন। ভাবতেন। তবে নিজে পড়ার চেয়ে শুনতে বেশি ভালোবাসতেন। দুপুরে রবীন্দ্রনাথ বই পড়ে শোনাতেন তাঁর নতুন বৌঠানকে, হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী।

কাদম্বরী একজন ভালো অভিনেত্রীও ছিলেন। নাট্যরসিক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল কাদম্বরীর মতো গুণবতী স্ত্রীকে পেয়ে। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে মাটির উঠোনে জ্যোতিরিন্দ্রের লেখা প্রহসন “এমন কর্ম আর করব না”-তে প্রথম অভিনয় করলেন কাদম্বরী। যে নাটকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নায়কের ভূমিকায়।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেত যাত্রার আগে এই প্রহসনটি সফলভাবে অভিনীত হয়। এরপরে ‘বসন্ত উৎসব’ এবং ‘মানময়ী’ নাটকেও কাদম্বরী বেশ ভাল অভিনয় করেন।

রবীন্দ্রনাথের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার ব্যপারে কাদম্বরীর উৎসাহ ছিল সকলের চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তারপর আকস্মিকভাবে কাদম্বরী চুপ করে যান। যার কারন জানা যায় না। কারো মতে বৌঠানের হয়ত অভিমান হয়েছিল, রবি তাঁর থেকে দূরে চলে যাবে এই ভাবনা কাদম্বরীকে ভাবিয়ে তুলেছিল।

রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই কাদম্বরীর অকাল-মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ঘটে আকস্মিক। কারো মতে, কাদম্বরীর মৃত্যু আকস্মিক হতে পারে কিন্তু অপ্রত্যাশিত একেবারেই নয়। কারণ গবেষকদের মতে- “কাদম্বরী ছিলেন প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট, সেন্টিমেন্টাল ও স্কিজোফ্রেনিক।” একবার ছাদ থেকে প্রায় পড়তে পড়তে বেঁচে যান। আর বাঁচিয়ে ছিলেন রবি ঠাকুরই।

কাদম্বরী দেবী ১৮৮৪ সালের আজকের দিনে (১৯ এপ্রিল) আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

More from BooksMore posts in Books »
More from InternationalMore posts in International »
More from Writer/ LiteratureMore posts in Writer/ Literature »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.