আত্মকথায় :- অর্জুন চক্রবর্তী : কবি, বিশিষ্ট অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী। সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল , আকাশ কালো মেঘের কল্যানে নিজের জৌলুষ হারিয়েছে। মুম্বাইয়ের বর্ষাকাল যে কি যন্ত্রণা দায়ক তা শুধু তারাই বুঝবে যারা ওখানে থেকেছে । সমুদ্রের গায়ের সাথে সেঁটে থাকা বেশ বড় বাংলোর মুখে হুমড়ি খাওয়া বারান্দায় বসে আমি আর বাসুদা (বিখ্যাত পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য)
বসে গরমা গরম তেলে ভাজা সহ চায়ের ওপর ভর করে আড্ডায় বিভোর । এখানে বলে রাখি , বাসুদার সাথে আমার পরিচয় , প্রথম যখন আমি মুম্বাই যাই তখন থেকে ।
আমি গুলজারের সহকারী হয়ে কাজ আরম্ভ করার পর সম্পর্কটা আরো কাছের মনে হত । এক কালের সনামধ্যন্য পরিচালক বিমল রায়ের সহকারী ছিলেন গুলজার ও বাসু
ভট্টাচার্য দুজনেই , সেই হিসেবে ওরা গুরুভাই । বিমল রায়ের সহকারী এবং পরবর্তী কালে স্বাধীন ভাবে কাজ করে সন্মান , জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ( হৃষিকেশ মুখার্জী , দেবু সেন , মূকুল দত্ত , আরো অনেকে ) এদের মধ্যে
এরা দুজনেও ছিলেন । এদের সাথে কাজ করে আবার অনেকে নিজেদের প্রমান করেছেন যেমন ,বাসু চ্যাটার্জি (বাসু ভট্টাচার্যের সহকারী ছিলেন) গুলজারের সহকারী মেরাজ , রাজ .এন .সিপ্পী .এন .চন্দ্রা ( যাঁর বিখ্যাত ছবি ‘অঙ্কুশ ‘ এ আমি অভিনয় করেছিলাম ) এবং আমি নিজে । র্হিষিকেশ মুখার্জির সহকারী ছিলেন বীরেশ চ্যাটার্জি যাঁর ছবি ,’ কড়ি দিয়ে কিনলাম ‘ এক সময় খুব জনপ্রিয় হয়ে ছিল , তাতে সনাতনের ভূমিকায় অভিনয় করে আমি প্রচুর সুখ্যাতি
কুড়িয়েছি । একটা বিশাল পরিবার ও আমি এই পরিবারেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ , এরম ধারণা শুধু আমার নয় আমাদের সবার মনে ভালো ভাবে বাস করে , এখনো । এই
ধারাবাহিকতা কে এনজয় করি আবার গর্ব ও হয় এই ভেবে যে এক সুত্রে বাঁধা এত মনিষীদের সাথে আমি ও আছি। চার বছর ভাই এর (আমি ‘ গুলজার ‘কে এই নামেই সম্বোধন করি ) সঙ্গে কাজ করার পর , দক্ষিন ভারতীয় বিখ্যাত পরিচালক ,’ কে . বালাচান্দারের ‘ ছবি ‘জারা সি জিন্দগী ‘ তে বেশ বড় একটি চরিত্রে অভিনয় করে অভিনেতা হয়ে যাই তারপর আমারই গুরুভাই ,’ এন . চন্দ্রা ‘ অঙ্কুশ ছবিতে আমায় মুখ্য ভূমিকায়
অভিনয় করার সুযোগ দিয়ে আমায় জনপ্রিয় করে তোলে ।
সেদিন বৃষ্টি ভেজা দুপুর বেলা , বাসুদার সঙ্গে বসে চা তেলে ভাজা খেতে খেতে সেই সব স্মৃতি আওড়াছিলাম , এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো , কথা সেরে বাসুদা ফিরে এলেন , তাঁকে যেন একটু বিচলিত মনে হলো । “মৃনালদা মুম্বাইতে আছেন , আমার এখানে আসছেন আজ , এখুনি ” । বাসুদার কথা সুনে আমিও উত্তেজিত , সেই ‘বাইশে শ্রাবণ , কলকাতা৭১, ভুবন সোমের ‘ মৃনাল সেন !
যাঁর ‘ নীল আকাশের নিচে ‘ ‘খারিজ ‘ ওকা কুরি কথা ‘ আলোড়ন তুলেছিল এককালে , সেই মৃনাল সেন ! অন্য এক কাজে যাবার তাড়া ভুলে গেলাম ! কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটে । দরজার বেল বাজলো । হন্ত দন্ত হয়ে বাসুদা যাঁকে নিয়ে
এলেন , প্রথমে তাঁকে দেখে , পরে তাঁর সাথে কথা বলে মন ভরে গেল । ধপ ধপে সাদা সুতির পাজামা পাঞ্জাবি , মাথায় উসকো খুসকো কাঁচা পাকা এক রাশ ঘন চুল , চশমার মোটা কাঁচ ভেদ করা তীক্ষ্ণ এক জোড়া অস্থির চোখ , ঠোটের ডগায়
হালকা মুগ্ধ করা ,হাসি যেন সর্বক্ষণের সঙ্গী । ওনার গল্পে প্রশ্নে উচ্ছাসে সারা বাড়ি যেন জেগে উঠলো । রিঙ্কি বৌদি (বাসুদার স্ত্রী ও বিমল রায়ের কন্যা ) চা সিঙ্গাড়া নিয়ে এলেন । সরল , সোজাসাপটা কথা গল্পে সব কিছু কেমন যেন সুন্দর হয়ে উঠলো । বাসুদা মৃনাল্ দা কে আমার কথা বলাতে উনি চমকে তাকালেন আমার দিকে , কারণ টা ওনার কথায় বোঝা গেল। ” আরে ! আমি তো ভাবলাম ও নর্থ ইন্ডিয়ার ছেলে , তা তুমি হিন্দি বলতে পারো ?” বাসুদাই আমার দুটো হিন্দি ছবি ও আমার গুলজারের সাথে সহকারিতার কথা ওনাকে বলাতে মুশকিল আসান ! অনেক্ষণ আমার হাত ধরে আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন । ” আমি একটা ছবি করব , হিন্দিতে , রমাপদ চৌধরীর গল্প, বীজ ‘ । তাতে একটা চরিত্র ,তুমি করবে?” আমার মনে হলো যেন হাওয়ায় ভাসছি! সজোরে ঘাড় নেড়ে হ্যা বলতে যাব , উনি বলে উঠলেন ,” শোনো তুমি আবার রাজেশ খান্নার মত গাছের ডাল ধরে গান করার জন্যে বায়না কোরনা যেন , আমি ওসব পারবনা !” সবাই এই কথায় হেঁসে যখন লুটো পাটি খাচ্ছে , তখন আমি বোকার মতো
ওনাকে বোঝাবার চেষ্টায় ব্যাস্ত যে আমার সেই ররম কোনো চাহিদাই নেই !
কলকাতায় শুটিং আমায় কবে যেতে হবে , কবে থেকে কাজ আরম্ভ , সব বলে দিলেন ।
কলকাতায় আমার নিজস্ব বাড়ি আছে জেনে খুব খুশি । উনি চলে যাবার পর ও আমি অনেক্ষণ বসে রইলাম বুঁদ হয়ে ।
যথা সময় কলকাতায় পৌঁছে ওনার বেলতলার ফ্লাটে গেলাম , কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও নিজেই দরজা খুলে আমায় দেখে হই হই করে উঠলেন । কিছু টা সময় কালো চা সহ আড্ডা , মুকুল বাবু ( মৃনাল দার প্রডাকশন দ্যাখেন ) আমায় অন্য ঘরে
নিয়ে গিয়ে কয়েকটা কাগজে সই করালেন , এর ই মধ্যে মৃনাল দা দুবার উঁকি মেরে বলে গেলেন ,’ টাকা কড়ির ব্যাপারে কোনো অসুবিধে হলে আমায় বোলো লজ্জা কোরনা। আমি শুনেই লজ্জা পেলাম ! আবার আড্ডা , এক সময় আমায় জিগ্যেস করলেন ।
” তোমার পরা পুরানো পাজামা আছে , শুটিং এ লাগবে ?” আমি তখন বাড়িতে বারমুডা বা বাবা কাকাদের মতো লুঙ্গি পরতাম , লুঙ্গির কথা শুনে উনি বলে
উঠলেন । ” না না লুঙ্গি না , লুঙ্গি পরে থাকলে মনে হয় You are easily available !
” হা হা করে সবাই হেঁসে উঠলো , দেখি উনিও মিটি মিটি হাসছেন !
একথা ওকথার পর আবার প্রশ্ন ।
” তুমি তো গুলজারের সহকারী ছিলে , তার মানে হিন্দি টা ভালই জানা আছে ? ”
চায়ে চুমুক দিয়ে মৃনাল দা আমার দিকে তাকালেন ।
আমি কিছু বলার আগে ওখানে বসা একজন বলে উঠলেন , ” অর্জুন তো হিন্দি বেল্টের ছেলে , ওর জন্ম ওদিকে , হিন্দি জানবেনা !? ”
ব্যাস আর কোনো কথা নয় আমাকে এই ছবির হিন্দি সংলাপ লিখে দিতে হবে এবং সংলাপ পরিচলকের দায়িত্ব ও সামলাতে হবে ! ওনার আবদার। রাজি না হয়ে উপায় নেই ।
যথা সময় অরোরা ষ্টুডিও তে শুটিং আরম্ভ হলো ।
সে সময় আমার গাড়ি ছিলনা , মুকুল বাবু কিছু বলার আগেই মৃনাল দার গলা , ”
অর্জুন কে আমি পিক আপ করব , ওতো পূর্ণ দাস রোড এ থাকে , কাছেই , অসুবিধে হবেনা । ”
মৃনাল সেন ! প্রতিদিন , তাঁর আম্বাসাডার গাড়ি করে আমায় তুলে ক্যামেরাম্যান কে . কে . মহাজন কে তুলে ষ্টুডিও যাচ্ছেন! ভাবা যায় ! শাবানা আজমি , শ্রীরাম লাগু , উত্তরা বাওকর , অনিল চ্যাটার্জি , অপর্ণা সেন , রুপা গাঙ্গুলি আরো অনেক ভালো ভালো অভিনেতা ছিল , যাদের সাথে কাজ করে যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম তা ঠিক ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবেনা ।
আমি নিজেকে খুব বভাগ্যবান মনে করি এই ভেবে যে , কে . বালাচান্দার থেকে গুলজার , এন .চন্দ্রা থেকে তপন সিংহ , নব্যেন্দু চ্যাটার্জি থেকে মৃনাল সেন ! কত সত্যিকারের পরিচলেকেদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি ।
কামাল হাসান , নানা পাটেকার , নাসিরুদ্দিন শাহ , শাবানা আজমি , দীপ্তি নাভাল , নীলু ফুলে , আবার ভারতী দেবী থেকে মুনমুন সেন , হরিধন ব্যানার্জি থেকে হারাধন ব্যানার্জি । কত শিল্পী , কত কিছু শিখলাম , জানলাম , আজও শিখে চলেছি ।
আমার পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি , ‘ টলি লাইটস ‘ যখন বেরোলো , স্বয়ং গুলজার ভাই এসেছিলেন মুম্বাই থেকে । ছবি দেখে মুগ্ধ ! আমার ছবিতে গীতা দের অভিনয়
দেখে ভাই বলে উঠলেন , ” ওনার অস্কার পাওয়া উচিত ! ”
আমার মুখে কথা নেই । গুলজার ভাই আমায় আশীর্বাদ করে মুম্বাই চলে যাবার কযেক দিন পর আমার ফোনে একটি কন্ঠস্বর ভেসে উঠলো ! সেই অতি চির পরিচিত গলা ! মৃনাল সেন ! আমাদের প্রিয় মৃনাল দা !
” কী ! মুম্বাই থেকে গুলজার এসে তোমার ছবি দেখে যাচ্ছে ! আমায় ডাকলেনা ! কেন ? ” কি বলবো কি বলব করে আমতা আমতা করে মুখ দিয়ে সত্যি কথাটা বেরিয়ে গেলো ! ”
দাদা আমার সাহসে কুলোয়নি , আপনাকে ডেকে আমার ছবি দেখাবো ! ”
” ওসব কথা ছাড়ো , কবে দেখাবে বল ? ”
” যেদিন আপনি বলবেন ! ”
” আরে আমি তো বাড়িতেই বসে , তোমার কবে সুবিধে হবে জানাও ? ”
” আজ দেখবেন ? প্রিয়া তে ? কাছেই , আমি নিজে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবো ! ”
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল !
” না না তার দরকার নেই , আমি চলে আসবো , তুমি থেকো কিন্তু । ”
অন্ধকার সিনেমা হল , আমর পাশে সেই মৃনাল সেন ! নীল আকাশের নিচে , ভুবনসোমের , খারিজের , এক দিন আচানাকের মৃনাল সেন ! পর্দায় ছবিটা ঝাপসা লাগে
কেন ? পলক ফেলেতে দেখি চোখের জল গালে ! একটা অদ্ভূত আত্মতৃপ্তিতে বুক ভরে গেল , আস্তে আস্তে আমার পাশে বসা মানুষটার দিকে তাকালাম । দেখি ,ধীমান পুরুষের গভীর নিঃসঙ্গতা নিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন একজন , পর্দার
দিকে !
আমাদের সবার গর্ব , সবার প্রিয় মৃনাল সেন ! আমাদের মৃনাল দা !
আজ মৃনালদার জন্মদিন….। মুম্বাই থেকে গুলজার এসে তোমার ছবি দেখে যাচ্ছে ! আমায় ডাকলে না কেন অর্জুন?- মৃনাল সেন…..।
More from BooksMore posts in Books »
- পম্পা সেনশর্মার কিশোর কবিতা সংকলন ‘রং তুলি ক্যানভাস’ প্রকাশিত হলো….।
- প্রেসক্লাবে প্রকাশিত হল তপন কুমার সামন্ত’র লেখা ধানের শীষে স্বপ্ন আছে নতুন ভোরের ….।
- বেদে” বিশ্বকর্মাকে সনাতন পুরুষ বা অজাত বলে বলা হয়েছে ৷ তিনি বিশ্বস্রষ্টা ও সর্বজ্ঞ….।
- কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় জন্মভূমিতে বিভূতি-জন্মোৎসব উদযাপিত হলো…..।
- নন্দন চত্বরে শারদ বই পার্বন শুরু হলো….।
- মায়ের কলমে নতুন করে প্রাণ পাচ্ছে র্যাগিংয়ের শিকার সৌরদীপ….।
More from CinemaMore posts in Cinema »
- দেখুন TV9 বাংলার নতুন নিউজ সিরিজ ‘মহাগুরুর দাদাসাহেব’….।
- ভূত মানুষের মজাদার গল্প নিয়ে ভূতনি বউ….।
- কাহিনীচিত্র ‘আনন্দ বিদায়’-এর পোস্টার ও প্রমো মুক্তি ঘটল….।
- দশরূপে দশভূজার ট্রেইলার প্রকাশ….।
- প্রেসক্লাবে বেস্ট ফ্রেন্ডস’ এর পোস্টার এবং গান প্রকাশ…।
- সময় এসেছে টেকনিশিয়ানদের মঙ্গল করার ভনিতার আড়ালে এই বেআইনি কার্যকলাপে লিপ্ত মানুষদের আসল রূপ চিনে নেওয়ার….।
More from EntertainmentMore posts in Entertainment »
More from InternationalMore posts in International »
- দেখুন TV9 বাংলার নতুন নিউজ সিরিজ ‘মহাগুরুর দাদাসাহেব’….।
- ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া বাটানগর শাখার উদ্বোধন…।
- পম্পা সেনশর্মার কিশোর কবিতা সংকলন ‘রং তুলি ক্যানভাস’ প্রকাশিত হলো….।
- ভূত মানুষের মজাদার গল্প নিয়ে ভূতনি বউ….।
- কালনাগিনী নদীবক্ষে মহিলাদের অভিনব তর্পনে উপচে পড়া ভীড়….।
- কাহিনীচিত্র ‘আনন্দ বিদায়’-এর পোস্টার ও প্রমো মুক্তি ঘটল….।
Be First to Comment