Press "Enter" to skip to content

আজকের এই বিশ্বপরিস্থিতির নেপথ্যের কারিগর মানবসভ্যতার নিষ্ঠুরতা……

Spread the love

সুব্রত ঘোষ: কলকাতা, ৪ এপ্রিল ২০২০ কোলকাতার যে অঞ্চলে আমি বাস করি তার সাথে আমার সম্পর্ক বহুদিনের। শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত আমার জীবনের প্রতিটি সত্তায় বিস্তৃত রয়েছে এই অঞ্চলের মায়াজাল। মূল রাস্তার উপর থেকে আমাদের পাড়ায় প্রবেশ পথের দুধারে, বিস্তৃত বড় বড় গাছের সারি যেন স্বপ্নিল শ্যামলীমায় আচ্ছন্ন করে রাখত। সময় প্রবাহের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে জনসংখ্যা, প্রযুক্তি হয়েছে উন্নত থেকে উন্নততর, পরিবর্তিত হয়েছে রাজনৈতিক পটভূমি, কিন্তু প্রকৃতি থেকেছে উদার, অনন্ত, অকৃত্রিম, অপরিসীম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বহুতল অট্টালিকা। নির্মম, নির্দয়ভাবে কাটা পড়েছে অসংখ্য বৃক্ষ।

কিন্তু পথের দুধারে সবুজের সমারোহের সৌন্দর্য থেকেছে আদি, অকৃত্রিম। মূল সড়ক থেকে পাড়ায় প্রবেশের ডান দিকে ছিল এক বিশাল বটবৃক্ষ। তার শাখা প্রশাখা এবং পাতার ঘনত্ব ছিল নিশ্ছিদ্র। সন্ধ্যাবেলায় সূর্যাস্তের সন্ধিক্ষণে পাখিদের কলতানে মুখর হয়ে উঠত গোটা এলাকা। শৈশবে স্কুল থেকে ফেরার পথে, বড় হয়ে কাজ থেকে ফেরার পথে, কয়েকটি মুহুর্ত দাঁড়িয়ে শুনতাম সেই অদ্ভুত কাকলির ঐকতান। তার শীতল ছায়া স্বস্তি দিয়েছে কত ক্লান্ত পথিককে, আবার প্রচুর মানুষ রুষ্ট হয়েছে পাখিদের বিষ্ঠায় আক্রান্ত হয়ে। মুচকি হেসে আমার বটবৃক্ষ, স্বগরিমায় ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের বুকে সবুজের আধিপত্য। এই তো কিছুদিন আগের কথা। একদিন কাজে যাওয়ার সময় প্রত্যক্ষ করলাম কিছু লোক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে কিছু নিরীক্ষণ করছে। কর্মব্যস্ততায় বিষয়টিকে তখন তেমন গুরুত্ব না দিয়ে চলে গেছি। ফেরার পথে বাস থেকে নেমেই হতবাক হয়ে দেখি রাস্তার ধারে পড়ে আছে গাছটার মোটা মোটা পুরুষ্টু কাটা শাখা প্রশাখা। অসহ্য যন্ত্রনায় মুচড়ে উঠল হৃদয়ের অন্তস্থল। একদিন-দুইদিন-তিনদিন, সমূলে উৎপাটিত হল গাছটি, জয়ী হল মানুষের বর্বরতা। বাস থেকে নেমেই, মনে হল এ কোনো অচেনা জায়গায় নেমে পড়েছি। আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম এক নিঃসীম শূন্যতা। পাখিদের কাকলির ঐকতান নিশ্চুপ। চারিদিকে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য, যেন এক অজানা ঝড়ের পূর্বাভাস। কানের ভেতর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি এক অব্যক্ত হাহাকার আর তার সাথে সাথে এক হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। আমি কান চেপে ধরতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন নিজের মধ্যেই হারিয়ে গেলাম। এক অপদার্থতা আর অপরাধবোধের গ্লানি নিয়ে ফিরে এলাম আমার পৈতৃক ভিটেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই জায়গায় সৌন্দার্যায়নের জন্য মহাসমারোহে প্রতিস্থাপিত করা হল মহাপুরুষদিগের মূর্তি।

উন্নত মানবজাতির মত্ত অহংকারে, শুধুমাত্র কৃত্রিম সৌন্দর্যায়নের নামে নিহত হল অকৃত্রিম, অমলিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। অকৃপণ, অকৃতদার প্রকৃতি বিধাতার রূপে, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, পরম যত্নে সৃষ্টি করেছেন মানবজাতিকে। তাদের ব্যবহারের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন অফুরন্ত প্রাকৃতিক উপাদানের সম্ভার। আর সেই মানবজাতি নগরোন্নয়নের নামে বিশ্ব জুড়ে চালিয়েছে প্রকৃতির ধ্বংসলীলা। বারে বারে প্রকৃতি সতর্ক করেছে, ভূমিকম্পের ধ্বংসে, সুনামির জলোচ্ছ্বাসে, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাতে, বিশ্ব উষ্ণায়ণে। উপেক্ষা করেছে মানবজাতি।

ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রকৃতির ভ্রূকুটিতে সারা বিশ্বের মানবজাতি আজ গৃহবন্দি। সৃষ্টিকর্তা, প্রকৃতির ঔদার্যকে স্বীকৃতি দিলেই মানবজাতির মুক্তি, আর তা না হলে, ধ্বংসের পূর্বাভাস, এই দুইয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আজকের মানবজাতি।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.