চিত্রন চৌধুরী: কলকাতা, ১৫এপ্রিল ২০২০ পয়লা বৈশাখ এসে গেলে প্রতিবারই মজার ছলে আমরা “একলা” বৈশাখ কথাটি ব্যবহার করে থাকি। এবার কেমন যেন সত্যি সত্যিই পালে বাঘ পড়লো! আজ থেকে ছয় মাস বাদে ভারত তথা পৃথিবীর করোনা জর্জরিত চিকিৎসা ব্যবস্থা তথা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তার আগাম ভবিষ্যৎবাণী করার যোগ্যতা বা পারদর্শিতা দুটোর কোনটিই আমার নেই। তবে আশাবাদী হতে দোষ কোথায়? তাই আজ থেকে শপথ নিচ্ছি আর ভুলেও পরের বছর থেকে মজার ছলে আর যাই হোক – “একলা” বৈশাখ বলা মোটেই চলবে না।
ঘরে বসে খোলা জানালাটার দিকে তাকালে মনে হয় গাছের পাতা গুলো কানে কানে কথা বলে। এতদিন খেয়াল করিনি। চড়াই আর চড়াইনি বারান্দায় আগেও আসতো। হয়তো দানা খুঁজে পেতোনা খুঁটে খাবার মতন। নিরাশ হয়ে কেবল ঘোরা-ফেরা করেই চলে যেত।
আর এখন আমি চাল ছড়িয়ে বসে থাকি কখন আসবে ভেবে। কলকাতার বহুতলের এক ফালি বারান্দা থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাচ্চারা – “প্লেন কোথায় বাবা, এখনোও আসছে না কেন?” – জিজ্ঞেসা করলে কিরকম বোকার মতন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। রাতে শুয়ে পাহাড় নদীর স্বপ্ন দেখি মাঝে মধ্যে। ঘুম ভেঙে যখন মনে হয় এখুনি ল্যাপটপ খুলে সারাদিনের মতন আবার দরজা বন্ধ করে অফিসের কাজে বসতে হবে, তখন মনে হয় – ঐ সত্যিকারের অসাধারণ নদী পাহাড়ের স্বপ্নটাই যেন এক রূপকথা ছিল ।
মাত্র দু-মাস আগের টাটকা স্মৃতি যে বহুযুগ আগের স্মৃতি ভেবে রোমন্থন করতে হয়, এই ধারণাটাও আমার আগে তেমন ছিলোনা। বড় ছেলে ইতিহাস বই খুলে Before Christ (BC) বললেও সন্দেহের চোখে তাকাই আজকাল। সত্যি Before Christ (BC) বলছে, নাকি আদপে বিফোর করোনা (BC) মানে করে বসে আছে মনে মনে!ভাগ্যিস, সৌভাগ্যবশত ফেব্রুয়ারির শুরুতেই আমাদের অভিযাত্রী দলের এবছরের সফরটি ভালোয় ভালোয় সমাপ্ত হয়েছিল। গন্তব্য – অরুণাচলের দিবাং অভয়ারণ্য।
এটি নাকি পৃথিবীর মধ্যে বাঘের উচ্যতম প্রকৃতিগত আবাসস্থল। সবুজের টানে ভারতের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, শত শহুরে ব্যস্ততা থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি নিয়ে, প্রতিবছরই একবার করে এই সময়টা আমরা বেড়িয়ে পড়ি, এরকম অভিযানে।
মজার ব্যাপার হলো, আজ অবধি যে সব ভয়ানক জঙ্গলের বিচিত্র সব জায়গায় আমরা পায়ে হেঁটে, রাতে তাবু খাটিয়ে ঘুরে এসেছি, সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পর্যটকদের নজরের অনেক বাইরে, আদিবাসী, বন্যপ্রাণ অধ্যুষিত এক অন্য পৃথিবী। “দিবাং ব্যাঘ্র প্রকল্প ছিল এদের মধ্যে অন্যতম দুর্গম, সভ্যতার আড়ালে থাকা, উত্তর-পূর্ব ভারতের শেষ প্রান্তের এক সম্পূর্ণ অপরিচিত নৈসর্গিক জগৎ।
অরুণাচলের “রোয়িং” – “হুনলি” – “আনিনি” হয়ে আমাদের গাড়ির রাস্তা “আসিচু”-তে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল। এর পরে শুরু পায়ে হেঁটে ব্যাঘ্র প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে, ড্রী নদীর অরণ্যময় উপত্যকা বরাবর রোমাঞ্চকর যাত্রা। রাতে নদীর ধারেই তাবু খাটিয়ে থাকা। গাড়ির যাত্রাও কিছু কম নয়। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে সবমিলিয়ে প্রায় ষোল ঘন্টার মতন। মাঝে আমরা অরুণাচলের “হুনলি” বলে একটি পাহাড়ি গঞ্জের চমৎকার “ইন্সপেকশন বাংলোতে” একদম নির্জনে পাহাড়ের মাথায় একটি অনন্য রাত কাটিয়েছিলাম।
শেষ দিন সেই নীল ড্রী নদীর ধারে তাবু গুটিয়ে ফিরে আসার সকালটা হঠাৎই আবার ধরা দিয়েছিলো গতকালের স্বপ্নে। অমন জনমানবহীন জায়গায় কোনো অভিযানে যাওয়া তো একপ্রকার Isolation -ই বটে। কিন্তু তেমনটি তো মনে হলো না স্বপ্নে আবার সেই রূপকথার দেশকে ফিরে দেখে! সেইদিন ড্রী নদীর স্বচ্ছ স্ফটিক গাঢ় নীল জলকে আঁকড়ে ধরেছিলো শ্বেত শুভ্র হিমালয়ের নুড়ি-পাথর গুলো। সেই নীল নদীর দুই বাহু বরাবর শাঁখে শাঁখে কোলাকুলি করে দাঁড়িয়ে থাকে পাইনের বন। সবুজ গালিচার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে হিমালয় এখানে সযত্নে জঠরে ধরে রেখেছে তার এই সদা চঞ্চল আগামীর নবজাতককে।
শৈল চূড়ায় চূড়ায় প্রথম আলোর টাটকা ফোটা বরফের সোনালী প্রজ্জলন, সব অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দেয়। বক্ষস্থলে তখন আলিঙ্গনে মত্ত মেঘমালা। অরুণাচলের মুগ্ধতাটুকু আমাদের শেষ তাবুতেই রেখে আসতে হয়েছিল সবিস্ময়ে !
Be First to Comment