————জন্মদিনে স্মরণঃ বিকাশ রায়————
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, ছবির নাম ‘৪২’। প্রিমিয়ার শো দেখতে গেছেন ছবিরই এক অভিনেতা। ছবি শেষ হতেই কিছু দর্শকের চোখ পড়ে তাঁর ওপর। তারপরই জুতো হাতে নিয়ে রে রে করে তেড়ে আসেন তাঁর দিকে। কারণ সেই অভিনেতা ইংরেজ-সহচর এক নিষ্ঠুর অত্যাচারীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অভিনেতা ভয় পাননি, করজোড়ে বলেছিলেন, ‘আপনাদের এই তিরস্কারই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার’। সেই অভিনেতার নাম বিকাশ রায়। অভিনেতা বিকাশ রায়। লম্বা। ছিপছিপে। ঋজু কাঠামো। ভাঙা মুখ, শক্ত চোয়াল। চওড়া কপাল, তীক্ষ্ণ নাক। আর গভীর, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যা ছিল অপ্রতিরোধ্য সেই সঙ্গে এক আশ্চর্য দুর্লভ কণ্ঠস্বরের জাদুময়তা। ম্যাটিনি আইডল ছিলেন না মোটেই বরং তার মতো চরিত্রাভিনেতার পাশে বহু ম্যাটিনি আইডল ম্লান হয়ে গেছে। সময়টা ১৯৪৬। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সামান্য প্রেজেন্টার-অ্যানাউনসারের চাকরি করছেন বিকাশ রায়। হঠাৎ-ই সু্যোগ এল সিনেমায় অভিনয় করার। সেই সময় চিত্রনাট্যকার জ্যোতির্ময় রায়, ততদিনে বিমল রায়ের ‘উদয়ের পথে’র চিত্রনাট্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে গেছেন, বছর তিরিশের যুবক বিকাশ রায়কে নিয়ে গেলেন পরিচালক হেমেন গুপ্তের কাছে। কলকাতার ভবানীপুরে ছিল বিকাশ রায়ের জন্ম ও বড় হওয়া। ভবানিপুরের মিত্র ইনস্টিটিউট থেকে প্রেসিডেন্সী কলেজ পর্যন্ত চলার মাঝে ছিল বহুমুখী প্রতিভার স্ফুরণ। তার মধ্যে অভিনয়ের প্রতি তাঁর ঝোঁক যা ছিল সেই ছেলেবেলা থেকে যদিও অনেকটা ঘুমিয়ে থাকা অ্যালবামের মতো। চলচ্চিত্রে পেশাদার অভিনেতা হবেন এমন কল্পনা তিনি কখনো করেন নি। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়া শেষ হবার পর আইন নিয়ে স্নাতক। প্রথমে কোন এক ব্যারিস্টারের সহকারী হয়ে ভবিষ্যতে দক্ষ আইনজীবী হবার বিফল প্রচেষ্টা। তারপর মোক্তারি ছেড়ে আশি টাকার মাস মাইনে নিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যোগদান। মাঝখানে রেডিও’র চাকরী ছেড়ে ডি জে কীমারের বিজ্ঞাপন সংস্থাতেও বেশ কয়েকদিনের জন্য ঢুকে পড়েছিলেন, পরে আবার রেডিওতে ফিরে আসা। আর সেখানে কাজ করতে করতেই চলচ্চিত্র অভিনয়ে পদার্পণ। বাংলা সিনেমার এক মাহেন্দ্রক্ষণে ভবিতব্য তাঁকে টেনে আনল স্পটলাইটের তলায়। এরপর চার দশক ধরে বাংলাকে তিনি দিয়ে যাবেন অসামান্য কিছু ছবি ও কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়া হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮) ছিল বিকাশবাবুর দ্বিতীয় ছবি। এই ছবিতে বিশ্বাসঘাতক মহানন্দের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিকাশবাবু। নায়ক হবার সু্যোগ পেলেন তাঁর তৃতীয় ছবি শ্রীমতী পিকচার্সের ‘অনন্যা’। ১৯৪৮ সালে রিলিজ। সেই প্রথম সিনেমার পর্দায় এক সঙ্গে বিকাশ রায় ও অনুভা গুপ্তা কমবয়সী রোমান্টিক নায়ক-নায়িকা সুকান্ত ও উমার ভূমিকায়। সিনেমায় প্রধান ‘অনন্যা’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কানন দেবী আর কমল মিত্র হয়ে ছিলেন ভিলেন রাঘব ডাক্তার। চিত্রগ্রাহক ছিলেন অজয় কর। ‘দিনের পর দিন’ ছবিতে বিকাশ রায়ের অভিনয় দেবকী কুমার বসুর নজরে পড়লো। দেবকী বসু ‘রত্নদীপ’ ছবিটিতে নায়ক রাখালের এক অনবদ্য চরিত্রচিত্রন করলেন বিকাশ রায়। রত্নদীপের পরেই মুক্তি পেয়েছিল ‘জিঘাংসা’, শার্লক হোমসের গোয়েন্দাকাহিনি ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’-এর ছায়া অবলম্বনে। পরিচালক অজয় কর। বিকাশ রায় ছিলেন প্রধান কুচক্রী এক প্রতিহিংসাপাগল বোটানিস্ট-এর চরিত্রে। অভিনয়ের পাশাপাশি এই ছবির অন্যতম প্রযোজক ছিলেন তিনি। ’৪২’-এর পর একদিকে ‘শাপমোচন’ (১৯৫৫) ছবির পৌরুষমদগর্বী অথচ মূঢ় কুমারবাহাদুরের ভূমিকা থেকে শুরু করে ‘জীবনতৃষ্ণা’ (১৯৫৭) ছবির সমাজ-পরিত্যক্ত অনাথ দেবকমল চরিত্র পর্যন্ত সব ভূমিকাকেই বিকাশ রায় অপ্রতিরোধ্য।
‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ (১৯৬৪) ছবিতে মেজর অনুপম ব্যানার্জী রূপে বিকাশ রায়ের ছোটো কিন্তু উজ্জ্বল অভিনয় যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছিল। ‘উত্তরফাল্গুনী’তে (১৯৬৩) ব্যারিস্টার মণীশ রায় হিসেবে বিকাশ রায় যে এক স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল চরিত্রচিত্রণ করেছিলেন, তাতেই সন্ধ্যাদীপের শিখা ছবিতে তাঁর অভিনয়ের পূর্বাভাস ছিল যেন। পরে ‘ছদ্মবেশী’ (১৯৬৫) ছবিতে খামখেয়ালী কিন্তু আদরণীয় ব্যারিস্টার প্রশান্ত ঘোষের ভূমিকায় অন্যরকম আর ‘আরোগ্য নিকেতন’ ছবিতে (১৯৬৯) এক গ্রাম্য কবিরাজ জীবন মশায়ের ভূমিকায় বিকাশ রায়ের অসামান্য অভিনয় প্রতিভার চিরন্তন সাক্ষর। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিকাশ রায়ের দুশো আটচল্লিশটি ছবি রিলিজ হয়েছে, সংখ্যাটা উপেক্ষেণীয় নয়। বিশেষ করে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সিনেমার পেশাদার অভিনেতা হিসেবে তাঁর সবচেয়ে ভালো সময়। তিনি ছিলেন জাত শিল্পী। অনস্বীকার্য। বহুমাত্রিক বিকাশ রায় অভিনয়ের সঙ্গে-সঙ্গে ছবির প্রযোজনা, পরিচালনা, কাহিনি-রচনা ও চিত্রনাট্য রচনাও করেছেন। বিকাশ রায় প্রোডাকশন-এর ছবিগুলি বিভিন্ন আঙ্গিকের। ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ও ‘সূর্যমুখী’ পারিবারিক ছবি। ‘বসন্ত বাহার’ সংগীতবহুল।বিকাশ রায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলিঃ ‘৪২’, ‘রত্নদীপ’, ‘জিঘাংসা’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘কীর্তিগড়’, ‘না’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘সব্যসাচী’, ‘বনহংসী’, ‘রাত্রির তপস্যা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘গলি থেকে রাজপথ’, ‘জতুগৃহ’, ‘জীবন কাহিনী’, ‘শ্রীকান্তের উইল’, ‘অনুপমা’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘অদ্বিতীয়া’, ‘শেষ অংক’ ও ‘কলঙ্কিত নায়ক’ অন্যতম। অভিনয় ছাড়াও ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’সহ তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমা পরিচালনা করেন। ‘নতুন প্রভাত’ ও উত্তমকুমার অভিনীত ‘রাজা-সাজা’ ছবির কাহিনি রচনা করেন বিকাশ রায়। এমনকি ‘কাজললতা’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘দুই পুরুষ’–এর চিত্রনাট্য তাঁর।
১৯৮৭ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি মারা যান।
বিকাশ রায় ১৯১৬ সালের আজকের দিনে (১৬ মে) কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment