শু ভ জ ন্ম দি ন অ প র্ণা সে ন
বাবলু ভট্টাচার্য : তিনি যখন কথা বলেন, তখন মুগ্ধ হয়ে শুধু তাঁকেই শুনতে হয়। তাঁর অভিব্যক্তি, অভিনয়শৈলী থেকে শুরু করে তাঁর কণ্ঠে থাকা স্পষ্ট দৃঢ়তা কিছুই যেন চোখ এড়াতে পারে না।
অপর্ণা সেন, ভারতীয় বাংলা সিনেমাজগতে এক অতি পরিচিত অতীত ও বর্তমান নাম। ভবিষ্যতের পথেও তিনি এক পা বাড়িয়েই রেখেছেন। অভিনয়, চিত্রনাট্য লেখা, চলচ্চিত্র নির্মাণ- একে একে সেলুলয়েড পর্দার সকল ধাপেই তিনি করতলের স্পর্শ রেখেছেন।
পারিবারিক আবহাওয়া ছিল শিল্পের ছোঁয়া লাগা, তাঁর পিতা চিদানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন একজন চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতা। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন অপর্ণা সেনের মামা অর্থাৎ তাঁর মা সুপ্রিয়া দাশগুপ্তের মামাতো ভাই।
চলচ্চিত্র জগতে তাঁর হাতেখড়ি ঘটে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার মধ্য দিয়ে। ১৯৬১ সালে ‘তিনকন্যা’ ছবিতে অভিনয়ই ছিল এক্ষেত্রে অপর্ণার প্রথম অভিজ্ঞতা। এতে ‘সমাপ্তি’ ভাগে ‘মৃন্ময়ী’ হয়ে দেখা দেন তিনি।
প্রথমদিকে বাণিজ্যিক ছবির তালিকা বেশ বড়ই ছিল তাঁর, কিন্তু যাকে বলে অন্যধারার ছবি, তার প্রতি অপর্ণার বরাবরই একটা আকর্ষণ ছিল। সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে এই পথে আসা তাঁর, পরবর্তীতেও এই মহাপরিচালকের ‘জনঅরণ্য’, ‘পিকু’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
এছাড়াও বাদ যায়নি ভিন্নমাত্রার পরিচালক মৃণাল সেন নির্মিত চলচ্চিত্রও। তাঁর ‘আকাশকুসুম’, ‘একদিন আচানক’, ‘মহাপৃথিবী’-তেও অভিনয় করেন অপর্ণা সেন।
বড় পর্দার নায়িকা অপর্ণা সেনের নায়কের তালিকায় রয়েছেন প্রায় সবাই। সবাই বলতে উত্তম কুমার, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, শুভেন্দু চ্যাটার্জি, ভিক্টর ব্যানার্জি, অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুর, দিলীপ কুমার, শত্রুঘ্ন সিনহা এবং আরো অনেকেই!
“আমি মিস ক্যালকাটা নাইনটিন সেভেনটিন সিক্স/এখনও তো কেউ জানে না, আমার স্ট্যাটিস্টিক্স!”- গানটির সাথে ‘বসন্ত বিলাপ’ সিনেমায় পশ্চিমা পোশাকে অপর্ণার স্বত:স্ফূর্ত নাচ আর অভিনয় সে সময়ে অনেক জনপ্রিয়তা পায়। আর ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীদের কাছে গানটি আজও জনপ্রিয় হয়েই আছে।
১৯৮১ সালে অপর্ণা সেনের প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’ মুক্তি পায়। এর জন্য তিনি ম্যানিলা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে গোল্ডেন ঈগল পুরস্কার পান। এটি তাঁর জন্য অবশ্যই একটি বড় সফলতা যে, তাঁর নির্মিত প্রথম ছবিটিই জাতীয় পুরস্কারও লাভ করে।
পেশাজীবনে তিনি শুধু চলচ্চিত্রকেই বেছে নেননি। তার বহুমাত্রিকতা প্রকাশ পেয়েছে এক্ষেত্রেও। সংবাদপত্র সম্পাদনা এবং নিউজ চ্যানেলে তাঁর দক্ষ কাজের দেখা মেলে। রাজনীতিবোধও তাঁর প্রবল এবং সেজন্যই প্রায় তাঁকে দেখা যায় প্রথাগত নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে।
অপর্ণা সেনের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র সমূহঃ ‘গয়নার বাক্স ‘, ‘ইতি মৃণালিনী’, ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’, ‘১৫ পার্ক অ্যাভিনিউ’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’, ‘পারমিতার একদিন’, ‘যুগান্ত’, ‘সতী’, ‘পরমা’, ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’।
এত এত বহুমাত্রিকতাই যার বৈশিষ্ট্য, তার প্রাপ্তির ঝুলিতেও খোঁজ মেলে অনেক কিছুরই। ১৯৭০ থেকে শুরু করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সাতটি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য এবং ২০০৩ সালে এসে আজীবন সম্মাননা দেয় তাঁকে ‘বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড’। এর মধ্যে ১৯৮৭-তে অপর্ণা পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’। দু’বার ‘আনন্দলোক’ পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন তিনি।
এছাড়া আরো রয়েছে কলাকার পুরস্কার, এটিও পেয়েছেন দু’বার। দু’বার লেখা হয়ে গিয়েছে অপর্ণার জীবনীও। ২০০২ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে সোমা চ্যাটার্জি ও রাজশ্রী দাশগুপ্তার কলমে উঠে এসেছেন অপর্ণা সেন।
অপর্ণা সেন ১৯৪৫ সালের আজকের দিনে (২৫ অক্টোবর) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment