সঙ্গীতা চৌধুরী: কলকাতা, ৫ মার্চ ২০২০ সম্প্রতি রবীন্দ্রসদনে এক অভিনব ঠুমরী উৎসবের আয়োজন করেছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ব অজয় চক্রবর্তী। এই পুরো অনুষ্ঠানের সংযোজনার কাজটি করেন ওঁর কন্যা সুরের অপ্সরা কৌশিকী চক্রবর্তী। ঠুমরীর একটা আলাদা গায়ন রীতি আছে। আর খেয়াল হল রাজার মত, তার নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে।যায় বাইরে সে যেতে পারে না।
কিন্তু ঠুমরীতে রাগ থেকে সরে গিয়ে অন্য রাগের আশ্রয় নিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে একটু ঘুরে আসা যায়। এই স্বাধীনতাটা ঠুমরীতে আছে। এই ধরনের গায়ন রীতি আগে খুবই শোনা যেত। কিন্তু এই সঙ্গীত ঘরানা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই এই ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত যাতে হারিয়ে না যায় তারই এক বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন পদ্মভূষণ প্রাপ্ত শিল্পী অজয় চক্রবর্তী। এক সময় যারা এই ঠুমরী গাইতেন তারা এই ঘরানার সঙ্গীত পরিবেশন করে দারুন নাম করেছিলেন, তাদের পর আজকাল ঠুমরী গাইবার শিল্পী সংখ্যা বড়ই কম।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ধারাকে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য হস্তান্তরের কাজটা কেউ করছেন না। তাই পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ওঁর নিজস্ব সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান শ্রুতিনন্দনে ঠুমরীর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্হা করেছেন। আর ঠুমরীকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ায় চেষ্টা চালাচ্ছেন।অনুষ্ঠানের শুরুতেই এই প্রথিতযশা শিল্পী জানিয়ে দেন কৌশিকী শুধু শিল্পীদের সঙ্গেই দর্শকদের পরিচিতই করবেন না, এই সঙ্গীত সম্পর্কে নিজের ধারনাও ব্যক্ত করবেন। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মিথিলার একজন বিখ্যাত পন্ডিত এস.কে. ঝাঁঁ।
তাকে পুষ্পস্তবক দিয়ে বরন করা হয়। এস.কে. ঝাঁ নিজের বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন , ” অজয় চক্রবর্তী সম্পর্কে বলার মত এত ক্ষমতা আমার নেই, তবে তিনি বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। শিল্পী চান যে প্রত্যেক ঘরে একজন করে অজয় চক্রবর্তী জন্মাক, এটা খুব বড় ব্যাপার”॥ঠুমরী সম্পর্কে কিছু বক্তব্যও রাখেন।
এরপর মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় আয়েশা মুখার্জীর সঙ্গীত দিয়ে।বড়ে গুলাম আলি খাঁ – র গাওয়া একটি ঠুমরী পরিবেশন করেন। এরপর অর্ঘ্য চক্রবর্তীর সঙ্গীতের পূর্বে সংযোজিকা কৌশিকী ঠুমরীর পরিচয় করান শ্রোতাকুলকে। কৌশিকী বলেন যে, “আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে পড়ে জেনেছি যে ঠুমরী কথাটা ঠুমক নাচ থেকে আসে। কিন্তু আমি যতটুকু ঠুমরী শুনেছি এবং ভালোবাসার তাগিদে একটু গাইবার চেষ্টা করেছি, তাতে আমার মনে হয় শুধু ঠুমক নয় বা শুধু নৃত্যের ভঙ্গিমার সঙ্গে যদি ঠুমরীর প্রয়োজনীয় সংযোগ স্হাপন করা হয় তাহলে তা ঠুমরীর আংশিক বর্ণনা হয়। কিছু কিছু সঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্যের অনুসঙ্গ আছে ঠিকই তবে ঠুমরীর এমন বিশাল অংশ আছে যেখানে নৃত্যের কোন প্রয়োজনীয় সম্পর্ক না- ও থাকতে পারে।
কিন্তু ঠুমরীর সঙ্গে যে বিষয়টির সম্পর্ক নিবিড় ,সেটা হল ভাব। সেই ভাব কখনো নিত্যনৈমিত্যিক, কখনো মানবিক, কখনো জৈবিক, কখনো বা ঐশ্বরিক। তাই আমার মনে হয় খুব সহজ হবে যদি আজকের প্রজন্মের জন্য ঠুমরী ভাষায় খুব ভারি না হয়। ঠুমরীর সব থেকে জরুরী নিয়ম হল ভাবের হাত কখনো না ছাড়া। ঠুমরীর সূচনা আমাদের পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন লোকগানের মধ্যে যে রাগগুলোর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি ছিল তাহলো – পিলু, কাফী, ভৈরবী ইত্যাদি এই ধরনের বহু রাগ যা ঠুমরী রাগ বলে পরিচিত ছিল।
তারপরে ভক্তিমূলক সাহিত্যেরও অনেক কিছু পরবর্তীকালে ঠুমরীতে এসেছে।আমাদের দেশের সঙ্গীতকে আলাদা আলাদা ভাগ করে বুঝতে চাইলে তা খুব শক্ত ব্যাপার। কারন পৃথক পৃথক জায়গার সঙ্গীতে সেখানকার রঙ, রূপ, গন্ধ সব মিলিয়ে থাকে। তাই গজল, ঠুমরী, কাজরী, টপ্পা, হরি, ঝুলা, হাভেলী সঙ্গীত- এর প্রত্যেকটা শৈলী একে অপরের সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে আবদ্ধ”। অনুষ্ঠানের ফাঁকে আরও অনেক কথা বলেছেন। কিছু অবশ্য বাকি থেকে যায়। অর্ঘ্য চক্রবর্তী ও বড়ে গুলাম আলি খাঁ -এর ঠুমরী গাইলেন। দুই শিল্পীর পরিবেশনাই অত্যন্ত নিপুণ ছিল। তবে সর্ব কনিষ্ঠা শিল্পী শ্রীময়ী আচার্যের সঙ্গীত মূর্ছনা দর্শকদের মাতিয়ে রাখে।
এরপর ঠুমরী পরিবেশন করেন রমাকান্ত গাইকয়াড। এই শিল্পী ও দক্ষতার পরিচয় দেন। এই অনুষ্ঠানের সর্বশেষ আকর্ষণ ছিলেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর ঠুমরী পরিবেশন। দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে শিল্পীর পর পর তিনটি পরিবেশনা ।পিলু দিয়ে শুরু করেন। আর ভৈরবীর রেশ নিয়ে সকলে বাড়ি ফেরে। প্রবীণ শিল্পীকে ওঁর শিষ্য অনল চ্যাটার্জী সঙ্গীতে সহযোগিতা করেন।তবলায় সঙ্গত করেন বিখ্যাত তবলাবাদক পন্ডিত যোগেশ সামসি।এ বছর থেকে শুরু করে এই উৎসবের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন শিল্পী।আরো আশ্বাস দেন যে পরের বছর এই উৎসব আরও দীর্ঘায়িত হবে।দু’দিন ধরে চলবে।তাই শেষ হয়ে ও নাহি হয় শেষ।
Be First to Comment