জন্মদিনে স্মরণঃ অ মি য় চ ক্র ব র্তী
বাবলু ভট্টাচার্য : রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন অন্যতম।
তাঁর পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন আসামের গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান এবং মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক।
অমিয় কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন আর থাকতেন মামার বাড়ীতে। উচ্চ শিক্ষিত মামাদের সংস্পর্শে এসে তরুণ অমিয় চক্রবর্তীর মানস জগত আলোকিত হয়ে ওঠে। বন্ধুস্থানীয় সেজ মামা সোমনাথ মৈত্র, অমিয় চক্রবর্তীকে ‘বীরবল’ ও ‘সবুজপত্র’ গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁর ভাষায় সবুজ পত্রের আসরে এবং পরে বিচিত্রার সভ্যরূপে সাহিত্যে সংগীতের প্রেরণা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হল।
কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর হাজারিবাগে আইরিশ মিশনের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে যথাক্রমে আইএ এবং ১৯২১ সালে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বোটানিতে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। কিন্তু ১৯২১ সাল থেকেই বিশ্বভারতীর কাজে কর্মে জড়িয়ে পড়েন ঘনিষ্ঠভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হলো সংর্কীণ।
শেষাবধি ১৯২৬ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন তিনি ১৯২৬ সালে। তিনি বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৩৪-৩৭ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কবি টমাস হার্ডির কাব্য নিয়ে গবেষণার জন্য ডি. ফিল. লাভ করেন ১৯৩৭ সালে।
ছেলেবেলা থেকে অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গীতের ওপর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাঁর শৈশব কেটেছে আসাম-গৌরীপুরে। গৌরীপুরে যাত্রা-নাটক আর জারি-সারি, বাউল-কীর্তনের আসরে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন। অন্যদিকে মামার বাড়ীতে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইয়োরোপীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর এই পরিচয় ছিল অসামান্য।
রাশিয়ার ববোডিন, জার্মানির প্রাতিভ এবং পিয়ানো, ভায়োলিন ও অর্কেষ্ট্রার শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের সঙ্গীতের সঙ্গে-সঙ্গে ভারতীয় মার্গসংগীতের নিত্য শ্রোতা ছিলেন তিনি। তারপর এক সময় গান লিখতে শুরু করেন। আর তাতে কখনো কখনো তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন।
১৯১৮ সালে অমিয় চক্রবর্তীর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে শান্তিনিকেতনে দায়িত্ব পান। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর কাজ ছিলো বিদেশী অতিথিদের পরিচর্যা করা, ক্লাস নেয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নানা গ্রন্থ-তথ্য সংগ্রহ সাহায্য করা, তাঁর বিদেশ যাত্রার সঙ্গী হওয়া ইত্যাদি।
১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তাঁর বিয়ে হয় কোপেনহেগেনবাসী হিয়োর্ডিস সিগার্ড এর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ বিদেশিনী নববধুর নাম দিয়েছিলেন হৈমন্তী।
প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতাবলী’ এবং ‘উপহার’ প্রকাশের পর ১৯৩৮-এ প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘খসড়া’- যার মধ্য দিয়ে তিনি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান দখল করে নেন।
তাঁর কবিতায় প্রগাঢ় দার্শনিকতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে প্রবল সময় ও সমাজ-সচেতনতা। ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের ধাঁচ, পংক্তি গঠনের কায়দা- সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন বাঙালী কবিদের মধ্যে অনন্য সাধারণ।
তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উপহার, এক মুঠো, মাটির দেয়াল, অভিজ্ঞান বসন্ত, পারাপার, পালাবদল, ঘরে ফেরার দিন, হারানো অর্কিড, পুষ্পিত ইমেজ, অমরাবতী, অনিঃশেষ, নতুন কবিতা, চলো যাই, সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর ৯টি বই রয়েছে।
কবিতার জন্য অমিয় চক্রবর্তী বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইউনেস্কো পুরস্কার (৬০), ভারতীয় ন্যাশনাল একাডেমী পুরস্কার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ (৬৩) এবং ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ (৭০) উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৮৬ সালের ১২ জুন তিনি শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।
অমিয় চক্রবর্তী ১৯০১ সালের আজকের দিনে (১০ এপ্রিল) পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment