Press "Enter" to skip to content

“হনুমান জয়ন্তী”……।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ১৬ এপ্রিল ২০২২।
“সঙ্কট মোচন হনুমানজী ” মানব জাতিকে মহা সঙ্কট থেকে উদ্ধার করুন ৷ ” হনুমান / বজরংবলী ” !
আজকের মতো এক চৈত্র পূর্ণিমার দিনে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার ভগবান রামচন্দ্রের পরম ভক্ত পবন – অঞ্জনার পুত্র রুদ্রাবতার “হনুমানের ” জন্ম হয় ৷ এবারে পড়েছে আজকের দিনে ১৬ এপ্রিল, শনিবার ( বাংলা ২ বৈশাখ ১৪২৯) ৷ মঙ্গল ও শনি বারকে আমরা সনাতন ধর্মীরা বজরংবলী হনুমানের দিন ভাবি ৷ তাই , আজকের শনিবার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ৷ আজ রবি ও হর্ষণ যোগ তৈরী হচ্ছে ৷ এদিন হস্ত ও চিত্রা নক্ষত্র থাকছে ৷ ভোর ৫টা ৫৫ থেকে রাত ৮.৪০ পর্যন্ত রবি যোগ এবং ভোর ২.৪৫ থেকে পরের দিন ১৭ এপ্রিল থাকছে হর্ষণ যোগ ৷ লাল জামা পরে লাল আসনে বসে ৯ বার প্রদীপ ঘুরিয়ে আমরা বলি ,” ওঁ মঙগলমূর্তি হনুমন্তে নমঃ “৷
” হং হনুমতে রুদ্রাত্মকায় হুং ফট্ হনুমতে নমঃ”৷
” হনুমান “- মানে যাঁর গর্ব হত হয়েছে বা হন (হত্যা)
এবং মানা (গর্ব)৷ আবার কদাকার চোয়াল বিশিষ্ট
– হনু ( চোয়াল) এবং মান ( কদাকার) বলে হনুমান৷
শিশু হনুমান খুব সুন্দর ছিলেন ৷ দুষ্টু ও পেটুক হনুমান সুমিষ্ট ফল ভেবে সূর্যকে গিলে ফেললে সৃষ্টি ধ্বংস হবে বলে ইন্দ্র বজ্র দিয়ে হনুমানের মুখে আঘাত করে সূর্যদেবকে বের করে আনেন ৷ তাই হনুমানের মুখ ঐরকম কদাকার হয় ৷ হনুমান চালীসাতে আছে , “যুগ সহস্র যোজন পর ভানু ৷
লীল্যো তাই মধুর ফল জানু “৷
১ যুগ =১২০০০ বছর, ১ সহস্র=১০০০ আর ১ যোজন =৮ মাইল৷ যুগxসহস্রx যোজন=১ ভানু ৷
৯৬০০০০০০ মাইল বা ১৫৩৬০০০০০০ কিমি৷ সেই কবে লেখা হনুমাল চল্লিশার হিসাব একবারে মিলে
যায় নাসার পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের হিসাবে ৷ যা শিশু বীর হনুমান একলাফে সূর্যকে ফল ভেবে খেতে পাড়ি দিয়েছিলেন !”বজরংবলী” মানে যার পা বজ্রের মত শক্তিশালী ৷ বজ্রের মত তাঁর শরীরের
রঙ ৷ যাঁর অস্ত্র – গদা, সঙ্গী – শুভরচলা ৷ তাঁর মা বানররাজ কেশরীর স্ত্রী অঞ্জনা শিবকে আরাধনা করে বর লাভ করে সন্তান লাভ করেন ৷ পবন (বায়ু দেবতার) পুত্র হনুমান কে তাই বলা হয় মহাদেব বা রুদ্রের অবতার৷ বিষ্ণুর অবতার “রামচন্দ্রের” সেবক হনুমান অমর ৷ আবার হনুমানের লেজে পার্বতী বা শক্তির অবস্থান ৷ হনুমান নিজের শরীরকে ইচ্ছামত ছোট বা বড় করতে পারেন ৷ যিনি রামপ্রসাদ ছাড়া আহার করেন না ৷ তাঁর প্রসাদে তুলসী পাতা না থাকলে তাঁর পেট ভরে না ৷ হনুমান পৃথিবীর প্রথম “মেডিক্যাল রিপ্রেজটেটিভ – যিনি হিমালয়ের গন্ধমাদন পর্বত লঙ্কায় উঠিয়ে এনে বানর ডাক্তার সুষেণকে দিয়ে অসুস্থ রাম – লক্ষ্মণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন ! হনুমান বিনয়ী ও বেদজ্ঞ ৷ সূর্যদেবের কাছে শাস্ত্রপাঠ নিয়েছেন ৷ তিনি প্রভু রামকে নিয়ে “হনুমৎ রামায়ণ” লিখেছিলেন ৷


দুনিয়ার প্রথম সার্জিকাল অপারেশনও তাঁর করা ৷
যিনি সফল কম্যান্ডোর মত লঙ্কাকে জ্বালিয়ে , পুড়িয়ে , তছনছ করে সফল ভাবে ভগবান রামের শ্রীচরণে ফিরে আসেন ৷ দ্বাপরে হনুমান আত্মগর্বী ভ্রাতা ( দুজনেই পবন পুত্র) ভীমের পথ আটকিয়ে বৃদ্ধবেশে শুয়ে ছিলেন ৷ ভীম রাস্তা থেকে সরতে বললে হনুমান বলেন লেজ সরিয়ে যেতে ৷ ভীম অপারগ হয়ে বোঝেন ইনি দেবতা ৷ তখন হনুমানের স্মরণ নেন ৷ অর্জুন সেতুবন্ধ রামেশ্বরমে এসে বলেন রাম বাণ মেরেই সেতু তৈরী করে লঙ্কা জয় করতে পারতেন ৷
বানর সেনার কোন দরকার ছিল না ৷ হনুমান অর্জুনকে বলেন তীর দিয়ে সেতু বাঁধতে ৷ অর্জুন না পারায় বজরংবলীকে প্রণাম করেন ৷ সেই থেকে অর্জুনকে রক্ষার জন্য তাঁর রথে “কপিধ্বজ” হয়ে হনুমান অবস্থান করেন ৷ তাই ,শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালে ও গীতা শোনালে অর্জুন , সঞ্জয় , বার্বারিক ও ঘটোৎকচের মত হনুমানও তা দেখেন ও শোনেন ৷ পুরীর মন্দিরের দক্ষিণ দেউড়ির নাম হনুমান দ্বার ৷ রাম নাম লেখা শিকলে তাঁকে বাঁধার জন্য এখানে রয়ে গেছেন ৷ হনুমানের দর্শন পেয়েছেন মাধবাচার্য ,
রামদাস স্বামী , রামেন্দ্র স্বামী , শ্রীসত্য সাঁইবাবা ৷আর তুলসীদাসকে দেখা দিয়ে তিনি “হনুমান চালিশা” লিখতে বলেন৷ এখনও শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ পেদ্রোতালাগালার উপজাতিরা বলেন ৪১ বছর অন্তর তাঁদের ভক্তরা হনুমানের দর্শন লাভ করেন ৷ শনিদেবের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন বলে যাঁরা বজরংবলীর ভক্ত তাঁদের উপর শনির কুপ্রভাব পড়ে না ৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা “মুরারী গুপ্ত কে হনুমানের অবতার মনে করেন ৷হিন্দীতে রামায়ণ অর্থাৎ “রাম চরিত মানসের ” রচয়িতা তুলসীদাসকে মনে করা হয় বাল্মীকীর অবতার ৷ যিনি রামলীলা লোকনাট্যের প্রবর্তক ৷ জনপ্রিয় স্তোত্র ” হনুমান চল্লিশার ” লেখক ৷ বারাণসীর “সঙ্কট মোচন ” হনুমান মন্দিরেরও প্রতিষ্ঠাতা ৷ চালিশা বা চল্লিশা অর্থাৎ চল্লিশটি চৌপাই বি কবিতার স্তবক ৷ হিন্দীতে জনপ্রিয়তম স্তোত্র ৷ বাংলা সহ নানা ভাষাতেও অনূদিত ও ব্যাপক প্রচার লাভ করেছে ৷ অনেকে রোজ এই গ্রন্থ পাঠ করেন ৷ বিশেষ করে মঙ্গলবারে৷ জয় বজরংবলী ৷ জয় সীতা রাম ৷
জয় বজরংবলী !
বজরংবলী বা হনুমানের পুজোর বাংলায় বিশেষ প্রচলন ছিল না ৷ ইদানিং অনেক পাড়ায় গড়ে উঠেছে “সঙ্কট মোচন ” মন্দির ৷ হিন্দী ভাষীদের প্রভাবে ৷ এমনই বিশাল “হনুমান মূর্তি ” দেখে এলাম কোচবিহার শহরে ও ব্যান্ডেলে ৷ ষাট ফুট উঁচু ৷ ভারতবর্ষের চার কোণে চারটি হনুমান তীর্থে বসছে চারটি বিশালাকার বজরংবলীর মূর্তি ৷ হনুমানজি চারধামের প্রথম মূর্তিটি হয়েছে সিমলায় ৷ আজ শ্রীহরিশচন্দ্র নন্দ ট্রাস্টের ১০ কোটি টাকা খরচে ১৮৮ ফুট মূর্তিটি( Idol of lord Hanuman)র আবরণ উন্মোচিত হচ্ছে গুজরাটের মোরবি শহরের কেশবনন্দন আশ্রমে ৷ তিন নম্বরটি হবে রামেশ্বরমে ৷ যাহোক , হনুমান চরিত্রের দুটি দিক আমার শ্রদ্ধা এনে দেয় ৷ একদিকে দাস্য বা সেবা ভাব ৷ আরেকটি তাঁর অমিত বিক্রম ৷ তিনি এমনই রাম ভক্ত যে সাগর ডিঙ্গোতে , গন্ধমাদন পাহাড় তুলে আনতে দুবার ভাবেন নি ৷ পবন দেব – অঞ্জনার এই ছেলেটি ছোট থেকে অসাধারন কাজ করেছে ৷ খাবার ভেবে ভানুকে বগলে পুরতে গেছে ৷ রাম তাঁকে কি চাও বললে উত্তর দিয়েছিলেন , “তোমার পাদপদ্মে যেন ভক্তি থাকে, ভুবনমোহিনী কোন মায়া যেন আমাকে গ্রাস করতে না পারে ” ৷ গুরু বা রামের আজ্ঞাপালন ও ব্রহ্মচর্য রক্ষার জন্য তিনি ব্রহ্মত্ব লাভকেও উপেক্ষা করেছেন ৷ তাই , এমন মহা জিতেন্দ্রিয় , মহাবুদ্ধিমান বীর হনুমানকে প্রণাম না করে থাকতে পারি না !এবার আসি “পঞ্চমুখী হনুমানের কথায় ৷ হনুমান বা বজরংবলী হিন্দু বৈষ্ণব ও শৈব উভয় শাখায় শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত দেবতা ৷ রামায়ণের অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র ৷ যিনি সেই ত্রেতা যুগ থেকে কলি যুগেও অমর হয়ে বেঁচে আছেন ৷ বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্রের তিনি সবচেয়ে বড় ভক্ত ৷ ত্রেতা যুগে তাঁকে সাহায্য করতে মর্ত্যে আগমন ৷ যিনি বুক চিঁড়ে দেখিয়েছিলেন রাম -সীতার অবস্থান ৷ আবার তিনি শিবের একাদশ তম রুদ্র অবতার ৷ একই সাথে তিনি বায়ুর দেবতা পবনের পুত্র ৷ তাঁর এক রূপ “পাঁচ মুখী হনুমান “! মা ভবাণীর উপাসক রাবণের ভাই পাতাল রাজ অহিরাবণের মায়াবী শক্তি কাটাতে বজরংবলী এই রূপ ধারণ করেছিলেন ৷ রামায়ণে আছে রাম ও লক্ষ্মণকে অহিরাবণ বন্দী করে তাঁর পাতাল পুরীতে নিয়ে গেলে বিভীষণের কথা মত তাঁদের মুক্ত করতে হনুমান পাতালে যান ৷ সেখানে দেখেন মহামায়ার ভক্ত অহিরাবণ মায়ের উদ্দেশ্যে পুরীর পাঁচ দিকে পাঁচটি দীপ জ্বেলে রেখেছিলেন ৷ এক সঙ্গে ঐ পাঁচটি প্রদীপ না নেভাতে পারলে ভবাণীর কৃপায় কেউ অহিরাবণকে হত্যা করতে পারবে না ৷আর সে জন্যই হনুমানজীকে পাঁচ মুখ ধারণ করতে হয় ৷ আবার মায়াবী মারিয়াল দৈত্য ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র চুরি করলে হনুমান তা ফিরিয়ে আনার সংকল্প করেন ৷ তখন হনুমান পাঁচ মুখ নিয়ে মারিয়ালকে বধ করে সুদর্শন চক্র ফিরিয়ে আনেন৷ এই রূপ পেলে ভগবতী পার্বতী তাঁকে পদ্ম ফুল ও যমরাজ শীষ নামের একরকম অস্ত্র হনুমানকে দেন ৷

হনুমানের পাঁচ মুখ হলো উত্তর দিকে হনুমান মুখ যা ভয় ভীতি দূর করে ৷ পশ্চিমে গড়ুর মুখ সব বাধা বিঘ্ন কাটায়৷ উত্তরে বরাহ মুখ ভক্তকে দেয় দীর্ঘায়ু ও ধন সম্পত্তি ৷ দক্ষিণের নরসিংহ মুখ সাহস যোগায় ৷ ঊর্দ্ধের হায়গ্রীব বা ঘোড়ার মুখ শুভকামনা দেয় ৷ এই পাঁচ মুখের মধ্যে নরসিংহ , গড়ুর ও বরাহ রূপ ভগবান বিষ্ণুর রূপ ৷ এই পাঁচ মুখের সবক’টিতে রয়েছে তিনটি করে চোখ ৷ যা আমাদের আধ্যাত্মিক , আধি দৈবিক ও আধি ভৌতিক তাপ মোচন করে ৷ মঙ্গলবারে লাল আসনে বসে লাল ফুল , তুলসী ও সিঁদুর দিয়ে এবং হনুমান চালিশা পাঠ করে ও হনুমানজীর বীজ মন্ত্র “ওঁ হং ওঁ” জপ করে হনুমানজীর পুজো তাই সনাতন ধর্মে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ৷ হনুমান গায়ত্রী ,” ওঁ হং হনুমতে বিদ্মহে আঞ্জনেয়ায় ধীমহি তন্নো বীরঃ প্রচোদয়াৎ “৷ গৃহস্থের অর্থনৈতিক উন্নতির সব বাধা কাটাতে বাড়ীর প্রবেশ দ্বারের উপরে পাঁচ মুখী হনুমানের ছবি লাগানো হয় ৷ তাতে অশুভ শক্তি ঘরে ঢুকতে পারে না ৷ নেতিবাচক শক্তি দূর হয় ৷ তাঁকে ধ্যান করি ,” মহাশৈলং সমুৎপাট্য ধাবন্তং রাবণং প্রতি ৷ তিষ্ঠ তিষ্ঠ রণে দুষ্ট ঘোরারাবং সমুৎসৃজন ৷ লাক্ষারসারুণং রৌদ্রং কালানতযমোপমম ৷ জ্বলদগ্নিলসন্নেত্রং সূর্য্যকোটিসমপ্রভম্ ৷ অঙ্গদাদ্যৈর্মহাবীরৈবেষ্টিতং রুদ্ররূপিণীম্ “৷ পঞ্চমুখী হনুমান স্তোত্র – ১. ওঁ নমোঃ ভগবতে পঞ্চবদনায় পূর্বা কপি মুখে সকলা শত্রু সমর্ণায়া স্বাহা ৷
২. ওঁ নমঃ ভগবতে পঞ্চবদনায় দক্ষিণ মুখে , করলা বদনায় নরসিমহায়া সকলা ভূতা প্রেত প্রমাদনায় স্বাহা ৷
৩. ওঁ নমঃ ভগবতে পঞ্চবদনায় পশ্চিমা মুখে , গরুদায়া সকলা বিশঃ হারানায় স্বাহা ৷
৪. ওঁ নমঃ ভগবতে পঞ্চবদনায় উত্তরা মুখে অধিভরহায়া সকলা সম্পদকারায় স্বাহাঃ ৷
৫. ওঁ নমঃ ভগবতে পঞ্চবদনায় ঊর্দ্ধ মুখে হায়গ্রীবায়া সকলা জন বশিকরণায়া স্বাহাঃ ৷
আমরা তাঁকে প্রণাম জানাই ,” রামেষ্টমিত্রং জগদেকবীরং প্লবঙ্গরাজেন্দ্রকৃত প্রণামম্ ৷
সুমেরুশৃঙ্গাগমচিত্ত্যামাদ্যং হৃদি স্মরামি হনুমন্তমীড্যম্ “৷

**(এই লেখকের লেখা “সনাতনী কৃষ্টি কথা” বইটি শীঘ্রই প্রকাশিত হতে চলেছে। এই বইটিতে থাকছে সনাতন ধর্মের এমন অসংখ্য কাহিনী ৷ হিন্দু ধর্মকে জানতে পড়ে মতামত দিলে লেখক খুশী হবেন ৷)**
(নিউজ স্টারডম কতৃপক্ষ)

More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »
More from SocialMore posts in Social »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.