Press "Enter" to skip to content

সগর রাজার মৃত পুত্রদের আত্মার মুক্তিকামনায় সগরের বংশধর দিলীপের ছেলে ভগীরথের তপস্যা বলে মা গঙ্গা জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের দশমী তিথি বা দশহরার দিন মর্ত্যে আসেন……৷

Spread the love

” মা গঙ্গা ( MAA GANGA)” গঙ্গা আমার মা।

ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ৭ ডিসেম্বর ২০২১।হিন্দুদের পবিত্রতম জলাশয় “গঙ্গা” ৷ গঙ্গা হলেন হিমালয় ও মেনকার কন্যা এবং পার্বতীর বোন ৷ বৈষ্ণবরা বলেন ব্রহ্মা কমন্ডলুর জল দিয়ে বিষ্ণুর পা ধোওয়ার সময় গঙ্গা অবতীর্ণ হন ৷ আরেক পুরাণ মতে নারদের অনুরোধে শিবের গান শুনে বিষ্ণু আংশিক দ্রবীভূত হলে ব্রহ্মা তা কমন্ডলুতে ধারন করেন ৷ এই দ্রবীভূত অংশই গঙ্গা ৷ তাই গঙ্গার আরেক নাম অঙ্ঘ্রিজা ৷ ব্রহ্মা গঙ্গাকে পবিত্র করে স্বর্গে উর্ত্তীণ করেছিলেন ৷ আর সগর রাজার মৃত পুত্রদের আত্মার মুক্তিকামনায় সগরের বংশধর দিলীপের ছেলে ভগীরথের তপস্যা বলে মা গঙ্গা জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের দশমী তিথি বা দশহরার দিন মর্ত্যে আসেন ৷ শিবের মাথার জটা হয়ে স্বর্গের নদী গঙ্গা পাতালে প্রবাহিত হওয়ার আগে মর্ত্যলোকের জীবদের মুক্তির জন্য প্রবাহিত হন ৷ স্বর্গ , মর্ত্য ও পাতাল তিন লোকের নদী বলে নাম হয় “ত্রিপথগা” ৷ ভগীরথ এনেছিলেন বলে তাঁর আরেক নাম “ভাগীরথী” ৷ আবার মর্ত্যে আসার সময় জহ্নু মুনির আশ্রম প্লাবিত করেছিলেন বলে ঐ মুনি রাগে সম্পুর্ণ গঙ্গাকে পান করে ফেলেন ৷ পরে ভগীরথের অনুরোধে নিজের জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্তি দেন ৷ তাই জহ্নু মুনির মেয়ে বলে পরিচিতা হন ৷ আর নাম হয় জাহ্নবী ৷ স্কন্দ পুরাণ মতে শিব -দুর্গার ছেলে কার্তিকের পালিকা মা হলেন গঙ্গা ৷ আবার পার্বতীর গাত্রমল থেকে উৎপন্ন গণেশের মূর্তি গঙ্গার জলে দিলে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ এজন্য গণেশকে বলা হয় দ্বৈমাতুর৷ অর্থাৎ দুই জননী দুর্গা ও গঙ্গা ৷

তাই আরেক নাম গাঙ্গেয়৷ ব্রহ্মবৈর্বত পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুর তিন স্ত্রীর অন্যতমা গঙ্গা ৷ পরস্পর কলহ হলে বিষ্ণু লক্ষ্মীকে নিজের কাছে রেখে শিবকে গঙ্গা ও সরস্বতীকে ব্রহ্মাকে দান করেন ৷ গঙ্গা ও সরস্বতী একে অপরকে মর্ত্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার অভিশাপ দেন ৷ এরফলে গঙ্গা ও সরস্বতী নদী হয়ে মর্ত্যে পতিত হন ৷ আবার মহাভারতে ভীষ্ম গঙ্গা ও শান্তনুর অষ্টম পুত্র ৷ দেবী হিসাবে গঙ্গার যে মূর্তি রয়েছে সেখানে বরুণের মত গঙ্গারও বাহন মকর (দেহাংশ কুমীর ও লেজ মাছের , জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্যাপ্রিকন ) ৷ গঙ্গা স্নান করলে সমস্ত পাপ দূর হয় বলে হিন্দুদের বিশ্বাস ৷ শুধু তাই গঙ্গা প্রবাহিত বলে এর তীরবর্তী স্থানগুলিকেও পবিত্র ভাবা হয় ৷ঋগ্বেদের ৩|৫৮|৩১ অংশে বলা হয়েছে ,” হে বীরগণ , তোমাদের আদিভূমি , তোমাদের পবিত্র সঙ্গীগণ , তোমাদের ধনসম্পদ সব জাহ্নবীর (গঙ্গা) তীরে “৷ মহাভারতের বনপর্বে (৭০/৯০) লেখা আছে “সর্ব্বং কৃত যুগে পুণ্যাং, ত্রেতায়াং পুষ্করং স্মৃতম্ ৷ দ্বাপরে তু কুরুক্ষেত্রং গঙ্গা কলিযুগে স্মৃতা” ৷ অর্থাৎ কলিযুগের সেরা তীর্থ গঙ্গা ৷ গঙ্গা স্নানে সব পাপ মুছে যায় ও জীব মুক্তিলাভ করে ৷

হরিদ্বারের ও কাশীর প্রধান আকর্ষন গঙ্গাস্তুতি বা Ganga Stotram আচার্য শঙ্করের লেখা পাঠ “দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে ত্রিভূবন তারিণী তরল তরঙ্গে / শঙ্কর মৌলী নিবাসিনী গঙ্গে মম গতি আস্থাম তব পদ কমলে ৷ ভাগীরথী সুখ দায়িনী মাতস্তব জলমহিমা নিগমে খয়াতঃ ৷ নাহং জানে তব মহিমানং পাহি কৃপাময়ী মামজ্ঞানম্ “৷ ব্রহ্মা কাশীরাজ দিবোদাসের সহায়তায় কাশীতে যে ঘাটে দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন সেই ঘাটের নাম “দশাশ্বমেধ ঘাট” ৷ কাশীতে গঙ্গায় নৌকায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ঘাটের কথা জানা ও দেখার সাথে দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গা আরতি দেখা এক পরম প্রাপ্তি ৷ সংস্কৃত স্তোত্রের সাথে অসংখ্য প্রদীপের ঝলকানি মনকে পবিত্র ও আনন্দিত করে ৷ এই ঘাটে আসেননি এমন পূর্ণাত্মা বিরল ৷

এই ঘাটে অভুক্ত শঙ্করাচার্যকে দেবী অন্নপূর্ণা আহার দিয়েছিলেন ৷ এই ঘাটে দেহ রেখেছিলেন বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী ৷ আবার বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দিয়ে সুন্দর পুকুর তৈরী করে বিশ্বনাথকে স্মরণ করলে এখানকার এই মণিকর্ণিকা ঘাটে শিব পার্বতী আবির্ভূত হন ৷ মাথা দুলিয়ে হর পার্বতী আনন্দ করার সময় এখানে মাথার মণিঅলঙ্কার খুলে পড়েছিল বলে ঘাটটির নাম হয় মণিকর্ণিকা ৷ এখানে রামকৃষ্ণ ও শ্যামাচরণ লাহিড়ীর সাক্ষাৎ হয়েছিল ৷ মণিকর্ণিকা ঘাটেই দেহ রেখেছিলেন কাশীর সচল বিশ্বনাথ তৈলঙ্গ স্বামী ৷ কাশীর মত
রোজ সন্ধ্যায় এখানে হয় গঙ্গারতি ৷ কাশী ও হৃষিকেশ ও হরিদ্বারে আরতি আমার বেশী আকষর্নীয় মনে হয়েছে৷ আরতি শুরুর আগে জায়গা নিতে হয় ৷ নচেৎ ভীড়ে দেখা কঠিন ৷ আরতি শুরুর পর হাজারো ঘন্টার ধ্বনি ও মন্ত্রের গাম্ভীর্য মনে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে ৷ লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থীর জলে ভাসানো প্রদীপ স্রোতের টানে ছুটে চলে ৷ দেখে মনে হয় আকাশের তারারা গঙ্গায় এসে মিশেছে ৷ পশ্চিমবঙ্গে হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাট বা চিন্তামণি দে ঘাটে , নবদ্বীপেও গঙ্গা আরতি দেখেছে এই প্রতিবেদক ৷ মথুরার বিশ্রাম ঘাটে হয় যমুনা আরতি ৷ হরিদ্বারের গঙ্গামাতার মন্দির , শঙ্করাচার্য ও বাল্মীকী মন্দির ক্লক টাওয়ারের কাছে ” গঙ্গা মাতা কি জয়” ধ্বনির মধ্যে হতে থাকে গঙ্গারতি ৷ এখানে গঙ্গার প্রবাহেরও বদল হয়েছে ৷ শহরের উত্তরে ভীমগোদায় বাঁধ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে কৃত্রিম স্রোত৷ হরিদ্বারের পশ্চিম ঘাটে রূপোর সিংহাসনারূঢ় গঙ্গামাতার মূর্তির পাশে প্রধান পুরোহিত সহ সাদা ধুতি চাদর গায়ে পূজারীরা সারিবদ্ধভাবে ঘন্টা বাজিয়ে মন্ত্রোচারণ করে মা গঙ্গার আরতি করেন ৷ হরিদ্বারে উত্তরবাহিনী পবিত্র গঙ্গার তীরে ছিল ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম ৷ হোমের আগুনে পুড়ে এখানে কুন্তী ও গান্ধারীর মৃত্যু হয় ৷ মহাভারতের বাণপ্রস্থ আশ্রম ছিল এই হরিদ্বারেই ৷
বিখ্যাত এই হিন্দুতীর্থের বিস্তারিত বিবরণ আছে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের লেখায় , মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ‘ তুজুক ই জাহাঙ্গীরী ‘তে আর সুপ্রাচীন কাল থেকে আমাদের নানা ধর্মগ্রন্থে ৷ নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থে লেখা আছে “কুম্ভমেলা ” র কথা আছে৷ তেমনি মনে রাখার মত এখানকার হরকী পাউরী ঘাটে প্রাত্যহিক “গঙ্গা আরতি “।

যা রোজ সন্ধ্যায় এখানকার প্রধান আকর্ষণ ৷কালিদাস লিখেছেন, ” নমাস্তহস্তু গঙ্গে তদঙ্গ প্রসঙ্গাদ্
ভুজঙ্গস্তু রঙ্গাঃ কুরঙ্গাঃ প্লবঙ্গাঃ ৷
অনঙ্গারিরঙ্গাঃ সসঙ্গা শিবাঙ্গা
ভুজগঙ্গাধিপাঙ্গী কৃতাঙ্গা ভবন্তি ৷”
“পরা পবিত্রা পূণ্যাখ্যা পাবণী পীতবাসিনী
পতিতোদ্ধারিণী ত্রিভূবন ধন্যা৷”
আমরা তাই গঙ্গামাতাকে ধ্যান করি ৷-
“ওঁ সুরূপাং চারুনেত্রাঞ্চ চন্দ্রাযুত সমপ্রভম্ ৷
চামরৈর্বীজ্য মানাঞ্চ শ্বেতচ্ছত্র উপশোভিতাম্ ৷৷
সুপ্রসন্নাং সুবদনাং করুণার্দ্র নিজান্তরাম্ ৷
সুধা প্লাবিত ভূপৃষ্ঠাম্ আদ্রর্গন্ধানুলেপনাম্ ৷
ত্রৈলোক্য নমিতাং গঙ্গাং দেবাদিভিঃ অভিষ্টুতাম্ ৷৷”
তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই ৷-
“সঃ পাতকসংহন্ত্রী সদ্যো দুঃখবিনাশিনী ৷
সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গঙ্গৈবঃ পরমা গতি ৷” বাংলা অর্থ গঙ্গা তৎক্ষণাৎ পাপ হরণ করেন , দুঃখ বিনাশ করেন , সুখদাত্রী মোক্ষদাত্রী তিনি , সেই গঙ্গাই আমার পরম গতি ৷ গঙ্গাষ্টকম্ -” মা! -তুমি জগৎচন্দ্রহার ৷ স্বর্গগামী ধ্বজা ৷ ইচ্ছা করি , তোমার তীরে দেহ ত্যাগ করিবারে , তোমার জলপান করে যেন চোখ বুজি ৷ তোমার নাম স্মরণ করে , নিজেকে সমর্পণ করি তব পায় “৷ ২৫২৫ কিমির এই পূর্ব বাহিনী নদী আমাদের জাতীয় নদী৷ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এর নদী অববাহিকা ৷ একরকম অণুজীবের জন্য এর ছিল নিজেকে শুদ্ধ করার ক্ষমতা ৷ অথচ , মানুষের অত্যধিক অত্যাচারে আজ পরিণত হয়েছে দূষিত জলাশয়ে ৷
১৩০ কোটি সনাতন ধর্মাবল্বীর মনের ইচ্ছা ৫০ কোটি মানুষ ও অসংখ্য জীবের কল্যাণে ভারত সরকারের “গঙ্গা একশন প্ল্যান” দ্রুত বাস্তবায়িত হোক ৷ স্বচ্ছ গঙ্গা আমাদের দেহ ও মনকে শুচি করে। গঙ্গার জল দিয়ে আমরা সর্বত্র শুদ্ধিকরণ করি কিন্তু সেই গঙ্গার জলকেই আমরা নোংরা করি। এই বিষয়ে সকল শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের একবার অন্তত ভেবে দেখা উচিত।

More from GeneralMore posts in General »
More from SocialMore posts in Social »
More from TravelMore posts in Travel »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.