জন্মদিনে স্মরণঃ কবি রজনীকান্ত সেন
“বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-
কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?”
——— রজনীকান্ত সেনে
বাবলু ভট্টাচার্য : বাংলা ভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সঙ্গীত রচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের বলা হয় ‘পঞ্চকবি’। রজনীকান্ত সেন সেই ‘পঞ্চকবি’দেরই একজন।
তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চার বছরের ছোট। অর্থাৎ তিনি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও সমসাময়িক কবি তিনি।
রজনীকান্তের মা মনমোহিনী দেবী সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তিনি বৈষ্ণব ব্রজবুলি ভাষায় রচিত প্রায় ৪০০টি বৈষ্ণব পদাবলির একটি সংকলন প্রকাশ করেন ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামে। এই ‘ব্রজবুলি’ নামের মিষ্টি কৃত্রিম কবি ভাষাটি মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে উদ্ভাবন করেন।
ছেলেবেলায় বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন রজনী। সারাদিনের দুরন্তপনা শেষে পড়াশুনার ফুরসতই মিলত না তাঁর। অসম্ভব মেধার কারণে বরাবরই পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন রজনীকান্ত।
ছোটবেলায় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে (তৎকালীন বোয়ালিয়া জেলা স্কুল) ভর্তি হন। কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ, কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ ও বিএল (ব্যাচেলর ইন ল’) পাস করেন।
রজনীকান্তের পিতা আইনজীবী হওয়ায় সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল। কিন্তু সাব-জজ পদে অধিষ্ঠিত হবার অল্প দিনের মাথাতেই অসুস্থতাজনিত কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন গুরুপ্রসাদ সেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারে নেমে আসে দারিদ্র্যের কষাঘাত। বিএল পাশ করে রজনীকান্তও পিতার মতো আইন ব্যবসায় নামেন।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত ‘আশালতা’ নামের মাসিক একটি পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় রজনীকান্ত সেনের কবিতা। গান রচনায় অস্বাভাবিক দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিলেন রজনীকান্ত। কলেজের কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হলে পরে রজনীকান্তের ডাক পড়ত। রজনীকান্ত অনুষ্ঠানস্থলে এসে অনুষ্ঠান চলাকালীনই গান রচনা ও তাতে সুর সংযোজন করে তা গেয়ে আসর জমাতেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলনে বিলাতী সব পণ্য বয়কট করে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার প্রতি যে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, সে আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের মতো রজনীকান্তও সমর্থন দেন। রজনীকান্ত রচনা করেন-
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।।”
তাঁর এই গানটি গণ-আন্দোলনে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জোয়ার সৃষ্ট করে। এর মাধ্যমেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন এবং ‘কান্তকবি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
রজনীকান্ত সঙ্গীত জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ঈশ্বর-ভক্তিমূলক গানগুলোর জন্যই। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম, বিশ্বাস ও আস্থা তাঁর গানগুলোতে প্রতিভাত হয়ে বাংলা গানকে গভীর দর্শন চিন্তায় স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। গভীর সংকটে যখন তিনি নিপতিত হয়েছেন, একে ঈশ্বরদত্ত আশীষ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।
মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন রজনীকান্ত। ছোটবেলাতেই তাঁর বড় ভাই ও বড় বোনের অকাল প্রয়াণ ঘটে। ছোট ভাই জননীকান্তও জলাতংক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই সকল মৃত্যু তাঁকে গভীর জীবনবোধে উজ্জীবিত করতে ভূমিকা রাখে।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেশাত্নবোধক গান রচনা এবং অসাধারণ সব প্রার্থনাসঙ্গীত রচনা করে আর জলসায় জলসায় গান গেয়ে যখন রজনীকান্ত পরিচতি পেতে লাগলেন, কিছুটা নাম-যশ পেয়ে উঠলেন, তখনই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর কণ্ঠনালীতে প্রদাহ দেখা দেয়। পরে চিকিৎসকেরা তাঁর কণ্ঠনালীতে ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসার সনাক্ত করেন।
তিনি এ সময় রবীন্দ্রনাথকে একবার দেখতে চান। হাসপাতালের বাজে পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের ছিল চরম অস্বস্তি। তা সত্ত্বেও, রজনীকান্তের অনুরোধ জানতে পেরে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান রবীন্দ্রনাথ। সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে হারমোনিয়াম বাজান আর গান ধরেন।
রজনীকান্তের শেষ দিনগুলো ছিল অসম্ভব ব্যথায় পরিপূর্ণ। তিনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০ সালে মঙ্গলবার রাত্রি সাড়ে আটটায় লোকান্তরিত হন।
রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ সালের আজকের দিনে (২৬ জুলাই) সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment