(((((((((((((((একটি প্রদীপ শিখা )))))))))))))))))) [[[[[[[[[[এ আঁধারে যতটুকু আলো করে রাখে]]]]]]]]]]]
ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র)
(প্রদীপ চন্দ্র সরকার)
কলকাতা: ১৭, মে ২০২১।
আমার গায়ের কোথাও লেখা নেই যে আমি কে, আমি কি এবং আমি নাকি ‘হিন্দু’, কেন হিন্দু সে কথাটাও লেখা নেই। । আমার বাইরে যদি কোনও মলিনতা, বা পোষাকে ময়লা লেগে থাকে তো সেটা বাইরের ব্যাপার। স্নান করলে , জামা পাল্টালেই ঠিক, পরিস্কার হয়ে যাবে। কিন্তু অন্তরের অন্তস্থলে আমি জানি, আমি পবিত্র,একটা খাঁটি মানুষ। “..যৎ সরেত পুণ্ডরিকাক্ষং স বাহ্য অভ্যান্তরে শুচি।।”
সব মানুষকেই আমি শ্রদ্ধা করি। যখন জন্মেছিলাম, সবাই একই রকম নিখুঁত ছিলাম ।ঈশ্বরের নিজের হাতে তৈরি বলে কথা। সৃষ্টিকর্তার নিজ-হাতে সৃষ্টি। যা পাল্টেছি, পরবর্তীকালে অন্যের প্রভাবে পাল্টেছি। জন্মের সময় আমাদের মুখে একই ভাষা ছিল। ‘ওঙ্গা’ বলে একই ভাষায় কাঁদার। তারপর ভাষা শিখে পাল্টেছি, আচরণ শিখে পাল্টেছি। কিন্তু অন্তরে অন্তরে আসল মানুষটা সবাই একই রয়ে গেছি। বিপদে না পড়লে সেটা নজরে আসে না।
অন্য কোনো ধর্মের মানুষকেই আমি খারাপ চোখে দেখি না। মানুষ খারাপ হবে কেন? আসলে তাদের বেড়ে ওঠার কায়দাটা আলাদা। যে দেশে তারা জন্মেছিলেন, বা বড় হয়েছেন, সেখানকার পরিবেশ হয়তো আলাদা রকমের। হয়তো সেখানে খুব তুষারপাত হয়, অথবা জল নেই – খা খা মরুভূমি, মানষজন কম, অথবা হয়তো ঠিক উল্টোটা, থিক থিক করছে ভীড়, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তারা হয়তো খুব ভদ্র অথবা হয়তো খুব ঝগড়ুটে । হয়তো সেখানে খুব ভূমিকম্প হয়, অথবা বন্য-প্রাণীরা বারবার আক্রমন করে, বারবার বন্যা হয়, অথবা চারদিকে ভাইরাসে আক্রান্ত রুগী। সেসব জায়গার আদব কায়দা, চলন- বোলন তো আলাদা হবেই । তাই বলে মানুষের পক্ষে মানুষ ক্ষতিকর হতে পারে না। মানুষের দুঃখ মানুষই বুঝবে। বিপদে এগিয়ে আসবে। ভালোবাসবে। সংসার করবে, অন্য কোনও প্রাণী সেটা দিতে পারবে না।
বিভিন্ন ধর্মের কাহিনী গুলোর সবকিছুই সত্যি কথা। ওগুলো হচ্ছে চরিত্র গঠন করবার জন্য, লতানো গাছের বেয়ে উঠবার অবলম্বন। কোনও কোনও লতা লাঠি বা কাঠি বেয়ে ওঠে, কোনওটা আবার অন্য গাছ বেয়ে, কোনও টা আবার উঠেই মাচা চায় আবার কোনও-টা মাটিতেই গুটি গুটি এগোয়। সবাই গাছ। এর মধ্যে ভালো খারাপের কিচ্ছু নেই। সবাই ভালো। নানা রকম ভালো।
নানা রকম মানুষের সঙ্গে মেলামেশার তাগিদে, বিভিন্ন ধর্মের কাহিনী শুনে আমি বড় হয়েছি। রূপকথার চেয়েও অপরূপ এবং শিক্ষণীয় সে-সব কাহিনী। কি সুন্দর আর উপদেশ পূর্ণ সে-সব কথা। শুনলে মন ভরে যায়। কিন্তু, সময়কাল তো পাল্টে গেছে, ওসব গল্প আর কেউ শুনতে চায়না, পড়তে চায় না। বলে সময় নেই। তাছাড়া নিঃস্বার্থভাবে সেই গল্পবলার লোকগুলোর সংখ্যাও কমে গেছে। ঠাকুমা দিদিমারা সব কোথায় যেন চলে গেছেন। টি ভি সিরিয়ালে হয়তো দেখাবার চেষ্টা করে, কিন্তু সেগুলো শেষ পর্যন্ত এতো নীচু মানের তৈরি হয় যে লোককে দেখতে না বলতে ইচ্ছে করে।
অবশ্য দৃশ্যকাব্য কি আর কল্প রাজ্যের সঙ্গে পাঞ্জা-লড়ে জিততে পারে? অসম্ভব। মহালয়া শুনতে ভালো লাগে, দেখতে ভালো লাগে না।
আমার ইচ্ছে ওই কল্প-রাজ্যকে দৃশ্য-শিল্পের ছোট্ট কৌটোয় ঠেসে না ঢুকিয়ে, তাকে গল্প-কথার মুক্ত হাওয়াতে রেখেই আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবার। আমি শুধু বলে যাবো, আপনারা শুনে যে যার মতো করে দৃশ্যপটে ভেবে নেবেন। তাহলেই তো হবে সত্যিকারের বর্ণনা। বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন মণি-মুক্তো, সব কটাই মূল্যবান, ঝলমলে, সব কটাতেই সত্যির প্রতিচ্ছবি। যেটা আমার হাতের কাছে পাবো, সেটাকেই আমার মতো করে গল্পের ছাচে বলবো। ভালোটা আগে, খারাপটা পরের কোনও বালাই নেই। সব, কটাই ভালো। উদ্দ্যেশ্য ? একটা ভালোর পরিবেশ সৃষ্টি করা।
আজকে মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের শেষ অংশ থেকে একটা কাহিনী আমার কথ্য ভাষায় বলবো। ভুল তো থাকবেই। আপনারা ঠিক করে নিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেবেন। নইলে আর মজাটা কোথায় ?!
@@@@@@@@@
তখন দ্বাপর যুগের শেষ লগ্ণ, কলিযুগ শুরু হবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। চারদিকে গলিত-মৃতদেহ শেয়াল কুকুর আর শকুনের টানাটানি ঝগড়া আর বিভৎস ডাকের মধ্যে মহাবীর দেবব্রত ভীষ্ম, সর্বাঙ্গ তাঁর তির গেঁথে ঝাঝড়া করে দিয়েছেন অর্জুন। সেই অবস্থাতেই নিঃসঙ্গ ভাবে শুয়ে ইচ্ছা- মৃত্যুর অপেক্ষায় আছেন। সঠিক যোদ্ধারা জানেন, এই শরীরে গাথা তির,গা থেকে খুলে নিলেই রক্তক্ষরণ শুরু হবে। এতো তিরের আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে দ্রুত মৃত্যু অনিবার্য। সেজন্য, যেখানে যে তির গেঁথেছে সেখানে থাকলে রক্তক্ষরণ কম হবে। আর কিছুটা সময় বেশি তিনি বেঁচে থাকবেন। সূর্য উত্তরায়নে আসা অবধি উনি মরতে চাননা। সেজন্য ওই বিভৎস ভাবে আহত হয়েই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে এক পাশে ওই তির গাঁথা ঝাঝড়া অবস্থাতেই শুয়ে আছেন। আসে পাশে কেউ নেই। সবাই মৃত।
তখন একজনের পায়ের শব্দ শুনে উনি চোখ বন্ধ করেই বললেন, “কৃষ্ণ এসেছো, এসো এসো, জানতাম তুমি আসবে।” কৃষ্ণ দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলে, প্রণাম জানিয়ে বললেন, “এসে যে আপনাকে ‘কেমন আছেন? ‘ জিজ্ঞেস করবো তার তো উপায় নেই। দেখতেই তো পাচ্ছি, কি অবস্থায় আছেন!! ”
ভীষ্মদেব একটু সময় নিয়ে বললেন, “যুধিষ্ঠির কি সিংহাসনে বসেছে , শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান কি হয়ে গেছে? … ওর দিকে একটু নজর রেখো।… এক এক করে তো সবাই চলে গেলো..হাল ধরার শক্ত মানুষ নেই… ফাঁকা! ওখানে তোমাকে থাকা প্রয়োজন।”
কৃষ্ণ চুপ করে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর ভীষ্মদেব আবার বললেন, ” খুব ভালো সময়ে এসেছো তুমি, ভালো সময়ে। একটা কথা মাথায় ঘুরছিলো, জবাবটা না পেলে মরেও শান্তি পেতাম না। প্রশ্নটা তোমায় করতে পারি? পৃথিবী ছাড়ার আগে উত্তরটা জানা প্রয়োজন। ”
—–“বলুন না কি প্রশ্ন? যদি জানি তাহলে বলবো।
—–“তুমি স-ব জানো। স—ব পারো। তুমিই তো ঈশ্বর!
——“না, পিতামহ। আমিই শেষ কথা নই। এভাবে লজ্জা দেবেন না। (কৃষ্ণ এসে ভীষ্মদেবের হাত ধরেন।) —“কী জানতে চাইছেন বলুন। ”
কঠিন যন্ত্রণার মধ্যেও ভীষ্মদেব বললেন, ” যিনি সত্যের প্রতীক, তিনি জানেন না কোনটা জনগণের পক্ষে ভালো আর কোনটা খারাপ? হাসালে কৃষ্ণ। ”
কৃষ্ণ হাত ধরেই বলেন,” কী জানতে চাইছেন আপনি? ”
—-” এই যে লড়াইটা হলো, তাতে এত লক্ষ লোক মারা গেল তো বটেই,সে নাহয় হলো,বীরের সঙ্গে বীরের যুদ্ধে ওরকম মরেই থাকে ; কিন্ত যেভাবে দ্রোণাচার্য কে বধ করা হলো, দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত খেলো, দুর্যোধনকে কোমরের তলায় আঘাত করা হলো, এগুলো কি যুদ্ধের রীতি অনুযায়ী খেলার আইনের মধ্যে পরে?
—–আমাকে দোষ দেবেন না পিতামহ। যে মেরেছে তাকে প্রশ্ন করুন। দুর্যোধনকে মারার জবাব দেবে ভীম। অর্জুন জবাব দেবে — কর্ণ আর জয়দ্রথকে মারার জন্য ,আমি তো এই যুদ্ধে একটা অস্ত্রও ধরিনি। ”
—–আবার পলিটিক্স করছো কৃষ্ণ, তোমার প্ল্যানেই তো সবাই সব কিছু করেছে। লোকে বলবে পাণ্ডবের জয় হয়েছে, আমি বলবো শ্রীকৃষ্ণের জয় হয়েছে। তাই তোমার কাছেই জানতে চাইছি,…কী পেলে?
——-“শুনুন পিতামহ, অন্যায় টন্যায় কিছু হয়নি। যা হবার তাই হয়েছে।
——এ তুমি কী বলছো কৃষ্ণ!! তুমি না রামের অবতার? তুমি কৌশলকে প্রশ্রয় দিলে পরবর্তী প্রজন্ম কী শিখবে? ওরাও বে-আইনী পথে জিতবে।
—-“পিতামহ, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়, কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে বদলাতে হয়। ‘যুগ’ নিজের প্রয়োজনে নিজের নায়ক নির্বাচন করে নেয়। রাম ত্রেতা যুগের নায়ক। আমার ভাগে পরেছে এই দ্বাপর যুগ। আমাদের দুজনের কর্মধারা এক হতে পারে না। রাম এবং কৃষ্ণের জমানার অনেক তফাৎ। রামের যুগে খলনায়ক রাবণ, শিবের ভক্ত ছিলেন। ওর দলে বিভীষণ এবং কুম্ভকর্ণ মতো সন্ত ব্যক্তি ছিলেন। সে যুগের খল নায়কেরা ধর্মজ্ঞান রাখতেন। কিন্তু আমার ভাগের যুগে কংস, জরাসন্ধ, দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনী,, জয়দ্রথের মতো ঘোর পাপীর মুখোমুখি হচ্ছি। সমাধানে ছলনা, ট্রিক, ম্যাজিকই ভরসা। পাপের শেষ করতেই হবে, যে ভাবেই হোক। ”
—–” কিন্তু কেশব, তোমার এই ছলনা শিক্ষা পরম্পরায় থেকে যাবে না তো?
—-“পিতামহ, ভবিষ্যতে এর চেয়েও বেশি ‘নেগেটিভ’ সময় আসছে। কলিযুগ আসছে। এই সামান্য ছলনা তখন যথেষ্ট হবেনা। তখন মানুষ কে কৃষ্ণের চেয়েও বেশি কঠোর হতে হবে। নইলে ধর্ম শেষ হয়ে যাবে। যখন ক্রুরতা এবং অনৈতিক শক্তি ধর্মকে সমূলে নাশ করতে চায়, আক্রমণ করে, তখন নৈতিকতা অর্থহীন হয়ে যায়। তখন মহত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘বিজয়’। শুধুমাত্র বিজয়। ‘যেন তেন প্রকারেন বিজয়’। ভবিষ্যতে এটাই শিখতে হবে।
—–কি ? ধর্মও নাশ হতে পারে?
—–সব কিছু ঈশ্বরের ভরসায় ছেড়ে দেওয়া মূর্খতা। স্বয়ং ঈশ্বর কিছুই করেন না। সব কিছু মানুষকেই করে নিতে হয়। ‘বিজয়’ও তাই।
ভীষ্মদেব সন্তুষ্ট হতে শুরু করলেন। প্রকৃত সত্য উনি জেনে ফেলেছেন। চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগলো। মুখে বললেন, ” কৃষ্ণ, এই পৃথিবীতে আমার থাকার শেষ লগ্ণ উপস্থিত। কাল বোধহয় আমাকে চলে যেতে হবে। আপনি (কৃষ্ণ) এই অভাগা ভক্তকে (ভীষ্মকে) কৃপা করুন।
কৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে প্রণাম করে ফিরে চললেন।
আর ওই যুদ্ধভূমিতে ভয়ঙ্কর অন্ধকারে ভবিষ্যত জীবনের সব চেয়ে বড় সূত্র সৃষ্টি হলো। যখন হিংসা আর অধর্মে পৃথিবী ডুবে যাবে তখন নীতি কথা মানা হবে আত্মহত্যার সমান। অন্যায় করাটাই হবে বাচার বিজ্ঞান। শুধু ‘বিজয়’ করো, ‘বিজয়’।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শৈলেশ কুমার বাগড়ী।
Be First to Comment