Press "Enter" to skip to content

মেয়ে সন্তানের প্রতি বাবার স্নেহের যে ছবি পাই, তা যেন বড় বেশি বাঙালি জীবনের বাস্তব ছবি। কখনও মনে হয়, ঐ ঢুসনা আসলে আমি, ঐ কুবের আমার ভাই আর ঐ নারায়ণ বাপটা আমার বাবাই!!

Spread the love

বেলা যে পড়ে এল ,জলকে চল —

শতরূপা সান্যাল : বিশিষ্ট চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক: কলকাতা, ২৮, অক্টোবর, ২০২০। পাবনা জেলার পোরজনা গ্রাম আমাদের পূর্বতন চৌদ্দপুরুষের ভিটে। দেশভাগের আগেই আমার ঠাকুরদা পাবনা ছেড়ে চলে আসেন এদেশে। তিনি ছিলেন সে যুগের গ্রাজুয়েট এবং এল এল বি পাস। তাকে দেখতে দশ গ্রামের লোক আসত। আমাদের সান্যাল পরিবার চিরাচরিত ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের মত বরাবরই যজন যাজন অধ্যাপনার কাজই করতেন। চাকরি নয়। ঠাকুরদার সময় থেকেই সব পরিবর্তন ঘটে গেল। উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত ঠাকুরদা ইংরেজের চাকরি করবেন না বলে শেষ পর্যন্ত বর্ধমান মহারাজার দেওয়ান হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। এপারে আসার সময় তারা সোনাদানা বা কোন অর্থ-সম্পদ আনতে পারেননি। কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন চৌদ্দপুরুষের সংস্কৃতি ,জীবনচর্যা এবং মেধা।

বর্ধমানের বাড়িটা ছিল ছড়ানো মতন। কোন প্ল্যান মাফিক তৈরি করা বাড়ি নয়। বাড়ির সামনে মস্ত বাগান আর বাড়ির পিছন দিকটাতে উঠোন। সেখানে শিউলি গাছ , কাঁঠাল গাছ, ডালিম গাছ , টিউবওয়েল, কুয়ো এবং স্নানের ঘর ছিল। শুনেছি ঠাকুরদা যেমন যেমন সামর্থ্য হতো একটি করে ঘর তৈরি করতেন। এই ভাবে বাড়িটি তৈরি হয়েছিল আমার ঠাকুরদা এবং ঠাকুমার অসম্ভব কষ্টে এবং যত্নে। শুনেছি আমাদের পরিবার শাক্ত। কিন্তু বাড়িতে ঘটা করে কালীপুজো হতে কখনো দেখিনি। বরং লক্ষ্মীপুজো হত কোজাগরী পূর্ণিমার দিন, বেশ ধুমধাম করে। সেই পুজোর প্রস্তুতি চলত দুর্গাপূজার সময় থেকেই। বাড়িতেই স্তুপিকৃত নারকেল ছাড়ানো, নারকেল কোড়ানো এবং তারপর তৈরি হতো নানান রকমের মিষ্টি। সারাবাড়ি সেই মিষ্টির গন্ধে মম করত। তিল, নারকেল, ক্ষীর, গুড়, চিনি ইত্যাদি দিয়ে সে সব মিষ্টি বানানো হত।

কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো তো সব বাঙালি হিন্দু বাড়িতেই হয় । কিন্তু আমাদের পুজোতে একটা অন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। কোজাগরী পূর্ণিমার মস্ত গোল চাঁদ উঠলে, বাড়ী বাড়ী থেকে উলুধ্বনি বা শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসত। তারপর ভোগ ও প্রসাদ বিতরণের পালা। সবার বাড়িতে পুজো হলেও বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রসাদ দিয়ে আসার রেওয়াজ ছিল। অন্য বাড়িতে পুজোর শেষে পাঁচালী পড়া হত। কিন্তু, আমাদের পরিবারে জ্যেষ্ঠ কেউ একজন মা লক্ষ্মীর মহিমার গল্প বলতেন। প্রতি বছরই দুটি গল্প বলা হত। একই কাহিনী, কিন্তু শুনতে খুব ভালো লাগত।

গল্পদুটো সংক্ষেপে এরকম: ১) ঢুসনার গল্প: মা লক্ষ্মীর ছেলে কুবের আর মেয়ের নাম ঢুসনা। ঢুসনার বিয়ে হয়েছে এক রাজার সঙ্গে। রাজরানী হয়ে ঢুসনার দেমাক দেখে কে ! সে মায়ের শেখানো সব সৎকর্ম ভুলে গেলো । ভুলে গেল লক্ষ্মী পুজো করতে। মেয়ের অলক্ষীপনা দেখে কুবেরকে মা পাঠালেন পুজোর কথা মনে করিয়ে দিতে। অলস ঢুসনা ঘুমোচ্ছিল অবেলায়। ছোট ভাই কুবের এসে তাকে ডাকতে, বিরক্ত দিদি এক ঝটকায় হাত দিয়ে তাকে সরিয়ে দিতে চাইল। দিদির সোনার কাঁকনের ধাক্কায় ভাইয়ের কপালটা গেল কেটে।বাড়ি ফিরতেই মা লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করলেন তোর কপাল কাটা কেন? কুবের বলল, ছট্-গুলি (ডাংগুলি) খেলতে গিয়ে কেটে গেছে। মা লক্ষ্মী সব বুঝলেন। খুব রেগে গেলেন মেয়ের ওপর। মা লক্ষ্মীর রাগ বলে কথা! তার ফল হলো মারাত্মক। রাজা এসে ঢুসনার ঘুম ভাঙাতে গেলে ঢুসনা এমন হাই তুলল যে, তার মুখ থেকে আগুন বের হলো আর রাজার গোঁফদাড়ি পুড়ে গেল। রাজা ঢুসনাকে ডাইনি মনে করে বাড়ি থেকে বার করে দিল।

ঢুসনা ভিখিরির মতো পথে পথে ঘোরে। তার মুখ নেই যে বাপের বাড়িতে ফিরে আসবে। নারায়ন সব জানেন বোঝেন আর কষ্ট পান মেয়ের দুর্দশায়। তিনি মেয়েকে বললেন, বাড়ির পেছনে এসে চুপ করে অপেক্ষা করতে। যখন খাবার সময় পিঁড়ি পড়বে তখন যেন চিৎকার করে ঢুসনা কাঁদতে থাকে এই বলে,”লক্ষ্মীরে মা ,নারায়ণ রে বাপ্ , কুবের রে ভাই ,তোরা সবাই থাকতে আমি এত কষ্ট পাই?” নারায়ণের নির্দেশমতো সেদিন বাড়ির চাকররা খাবার আগে কাঠের পিঁড়িগুলো দুমদাম শব্দ করে ফেলতে লাগলো। অমনি ঢুসনা বাড়ির পিছন থেকে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিলো বাবার নির্দেশমতো। নারায়ন বললেন, কে কাঁদছে? ঢুসনার গলা না? লক্ষ্মী বললেন, ও কিছু না। তুমি খাও! নারায়ণ বললেন, যে কাঁদছে তাকে না দেখে আমি খাব না ! নারায়ণের বুদ্ধির কাছে লক্ষী হেরে গেলেন। ঢুসনাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। মেয়ে তার ভুল বুঝতে পেরে মায়ের পায়ে পড়ল। মাও তার সব দোষ ক্ষমা করে দিলেন। ওদিকে রাজারও ঢুসনার কথা মনে পড়ল। তিনি তাকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। নারায়ন বললেন,আবার তাকে নতুন বৌ এর মত করে নিয়ে যেতে হবে সাড়ম্বরে সাদরে। তাই হল। যাবার সময় মা লক্ষ্মী ঢুসনাকে দিলেন “সোহাগের ট্যাঁপারি‘। পালকি করে ঢুসনা যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে তখন সেই ট্যাঁপারি থেকে সোহাগ উথলে উথলে পড়তে লাগলো। সেই সোহাগ জেলেনি নিয়ে গেল মাছের চুবড়িতে, কিষাণী নিয়ে গেল ধামাকুলোয়, বধুরা নিয়ে গেল আঁচলে করে। মা লক্ষ্মীর কৃপায় সবাই মনে সোহাগ নিয়ে, আনন্দে ,সুখে -স্বাচ্ছন্দে ঘর সংসার করতে লাগলো।

গল্প দুই: তাড়ুর গল্প। এক ধনী বাপের মেয়ের বিয়ে হয়েছিল গরিব বাড়িতে। সেখানে তার আদর-ভালোবাসার অভাব ছিল না। কিন্তু অভাব ছিল আর সব কিছুতেই। একবার, বাপের বাড়িতে মস্ত উৎসব। মেয়ের কাছে নেমন্তন্ন এলো না। মেয়ে তবু বলল, আমি যাব। বড়লোক বাপের বাড়িতে তখন এলাহি আয়োজন। বহু অভ্যাগত। সবার অনেক আদর যত্ন কিন্তু মেয়েটির প্রতি বড়ই অবহেলা। মেয়েটির একটা ছোট্ট ছেলে ছিল যার নাম তারু। তারু বলল , মা , খিদে পেয়েছে। মা এসে রান্নাঘরে তার ভাই বউদের বলল, রান্না হয়ে থাকলে তারুকে একটু খেতে দাও না! ভাই বউ বলল , এত খাই খাই কিসের ? ওইখানে ভাতের মাড় আছে। ঐ মাড় দাও। মা বললেন, কিসে করে দেব? ভাই বউ বললে ওই যে ওখানে ডাঁই করা শালপাতা আছে ,ওখান থেকে পাতা নিয়ে ঠোল (ঠোঙা) বানিয়ে দাও।

এই অপমানে, অনাদরে, লজ্জায়, ঘৃণায় মেয়েটির আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করলো। সে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় পথে পেল একটা মৃত গোসাপ। সেটাকে নিয়ে এসে বাড়ির উঠোনে উনান জ্বালিয়ে সেদ্ধ করতে দিল। আজ সে সপরিবারে ওই বিষাক্ত খাবার খেয়েই মরবে!আকাশপথে সেই সময় পেঁচার পিঠে করে উড়ে যাচ্ছিলেন লক্ষী ও নারায়ন। নারায়ন বললেন লক্ষ্মী, তোমার কৃপা না পেলে এই পরিবারটা যে মরে যাবে। লক্ষ্মী বললেন এটা ওদের কর্মফল। নারায়ন লক্ষীর কোন যুক্তি মানতে চাইলেন না।তিনি বললেন, ওরা সৎ , ওরা ভালো। তুমি একবার অন্তত চোখের কোনা দিয়ে ওদের দিকে তাকাও। তাহলে একটা পরিবার বেঁচে যাবে। লক্ষ্মী তাই করলেন। আর অমনি উঠোনে সেদ্ধ হতে থাকা গো সাপটা পরিণত হল সোনাদানা হীরে-মুক্তো ইত্যাদিতে। ওরা লক্ষ্মীর কৃপায় রাতারাতি ধনী হয়ে গেল।

আবারো বাপের বাড়িতে অনুষ্ঠান। এবার কিন্তু তাকে সাদরে নেমন্তন্ন করা হল। মেয়েটি ছেলে, ছেলের বউ ইত্যাদি সবাইকে নিয়ে সেখানে গেল। সেখানে তাদের খাতির দেখে কে। খাবার সময় ছেলের বউরা অন্ন নিয়ে মুখে তুললনা। নিজেদের হাতের গয়নায় ছুঁইয়ে বলতে লাগলো, শাঁখা রে সোনা, তোর গৌরব না মোর গৌরব? ওদিকে সেই ছোট্ট তারুর পাযে সোনার মল ঝুমঝুম করে বাজছে। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িতে । সেই মল থেকে শোনা যাচ্ছে” প্রিয় মাসী ,প্রিয় মা, ঠোল সিও (সেলাই করো), মাড় পিও”!

মেয়েটি সবার সাথে দেখা করে ছেলে, ছেলের বৌদের সবাইকে নিয়ে নিজের বাড়িতে যাবার জন্য পা বাড়ালে ভাই বৌরা বলল, কি হলো তোমরা খেলে না ! খাবে না ? মেয়েটি বলল , না! মানুষের সম্মান যেখানে নেই , শুধু টাকা-পয়সা সোনাদানার সম্মান , সেখানে আমরা খাইনা!

প্রত্যেক বছর এই গল্প আমরা শুনতাম কিন্তু কখনো পুরনো হয় নি। পরে বর্ধমানের পাট পুরোপুরি চুকে যায়। আমাদের কলকাতার বাড়িতে মা করতেন কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। মা যতদিন বেঁচেছিলেন একটা বছরও বাদ যায়নি। ঠিক বর্ধমানের মতোই আমাদের বাড়িতেও পুজো হত , ভোগ হত , সারা বাড়ি জুড়ে আল্পনা আঁকতাম।আর তারপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রসাদ দিয়ে আসতাম। বাবাই কোনদিনই এসব পূজা আচ্চায় থাকতেন না। তিনি তাঁর ড্রইংরুমে বসে বই পড়তেন অথবা বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো গল্পগাছা করছেন। পুজো শেষ হলে বাবাকে আমরা ডেকে নিয়ে এসে বলতাম, বাবাই গল্প বলো। বাবাইও প্রত্যেক বছর ওই ঢুসনার গল্প আর তাড়ুর গল্প শোনাতেন, মোড়ায় বসে।

ওই গল্প দুটিতে ভক্তির কথা কতটুকু আছে জানিনা। তবে সমাজ, সময় এবং নর-নারীর সম্পর্ক, পরিবারে ভালোবাসার টান, ভাই-বোনের ভালোবাসা,মেয়ে সন্তানের প্রতি বাবার স্নেহের যে ছবি পাই, তা যেন বড় বেশি বাঙালি জীবনের বাস্তব ছবি। কখনও মনে হয়, ঐ ঢুসনা আসলে আমি, ঐ কুবের আমার ভাই আর ঐ নারায়ণ বাপটা আমার বাবাই!!

ছবিতে: মায়ের কোন এক বছরের লক্ষ্মীপুজো, আমার দুই কন্যা (ঋতাভরী ও চিত্রাঙ্গদা) তাদের দিদামার লক্ষ্মীপুজোর সাজে, বাবাই, মা, কোজাগরী চাঁদ।

শতরূপা সান্যাল

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.