Press "Enter" to skip to content

মা কালী ও পঞ্চ’ম’ -কার সাধনা…..।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫।শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচারে ঘর ( স্বর্গ) ছাড়া দেবতারা হিমালয়ে গিয়ে অসুরদের হাত থেকে মুক্তির আশায় দেবী পার্বতীর আরাধনা করলে দেবীর দেহ থেকে জন্ম নিলেন ” দেবী কৌশিকী ” ৷
রং কালো বলে ঐ দেবীর নাম হলো “কালী ” !
” কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষিতাম্
সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড়্গবামাধোর্দ্ধক রাম্বুজাম্
অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোদ্ধোর্ধপিণিকাম্
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্ ৷”
ভগবান শিব স্বয়ং জগৎজ্জননীর সঙ্গে ভক্তের মিলিত হওয়ার উপায় হিসাবে পঞ্চ “ম” কার তন্ত্র সাধনার প্রবর্তন করেন ৷ আমাদের পূজা তিন রকমে হয় ৷ বৈদিক , পৌরাণিক ও তান্ত্রিক ৷ তন্ত্রের প্রচলন হাজার হাজার বছর আগে ৷ বিশ্বাস করা হয় তা শিবের মুখ নিঃসৃত ৷কুলাচার বা কৌল মতে সাধনা ছাড়া শক্তি মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয় ৷ এই সাধন পথ বড়ই কঠিন ৷ তন্ত্র মার্গের ক্ষুরধার পথে পদে পদে থাকে পতনের ভয় ৷ এটা প্রবৃত্তি মার্গের নয় নিবৃত্তি মার্গের সাধনা ৷ নানা প্রলোভন জয় করতে হয় ৷বিকৃত সাধনা তন্ত্র তথা পঞ্চ ম কারের নামে অনেক সময় চলে ৷ যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে এই বীরাচারী শাক্ত সাধনায় ৷ পঞ্চ ম কার সাধনা মদ , মাংস , মাছ , চালভাজা , চানাচুর বা মেয়ে সঙ্গে রেখে এগুলো রূপক ৷ কিন্তু , উপাদেয় বলে ভ্রষ্ট মানুষ এর আসল কথা প্রকাশ করেনা ৷মদ, মাংস, মাছ , মুদ্রা ও মৈথুন এর অপব্যাখ্যা হয়েছে ভোগ আর তৃষ্ণা ৷ বেদান্ত মতে সাধনায় প্রথমেই ভোগ ত্যাগ করতে হয় ৷ তন্ত্রে সেই বাধা নেই ৷ যোগ ও ভোগ একসাথে করা যায় ৷ তাই , সাধারণ মানুষের এটা বাস্তব ও সহজ মনে হয় ৷ আসলে কিন্তু ভোগের সামগ্রীর সঙ্গে থেকে মনকে একাগ্র করাই তন্ত্র সাধনা ৷করতে হয় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের শুদ্ধিকরন ৷যা আছে ব্রহ্মান্ডে তা আছে আমাদের দেহ ভান্ডে ৷ “ওঁ” মোক্ষ পাওয়ার সাধনা ৷ “ক্রীং” ধনলাভ , “শ্রীং” কাম লাভ আর “হ্রীং” ধর্ম লাভ এর মিলিত ফল নিয়ে তন্ত্রের মন্ত্র “ওঁ হ্রীং শ্রীং ক্রীং পরমেশ্বরী স্বাহা “৷ পুরুষ আর প্রকৃতির মিলনেই সৃষ্টি ৷ তাই , হিন্দু ধর্মে যে কোন ধর্মীয় কাজ যজ্ঞ , দীক্ষা , পূজা অর্ধাঙ্গ স্বরূপিণী স্ত্রীর সঙ্গে একযোগে করতে হয় ৷ শৈব মতে স্ত্রীকে বরণ করে চক্রে বসাতে হয় ৷ তন্ত্রে ভৈরবীচক্রে পত্নীকে শক্তিরূপে পেলে অন্য নারীর দরকার হয় না ৷ নারী এখানে আদ্যাশক্তিরূপিণী জগজ্জননী ৷ পঞ্চ ম-কার সাধনায় সাধক কাম , ভয় ,লোভ জয় করেন ৷এই সাধনা বাইরের নয় অন্তরে শক্তি দেয় ৷ পার্থিব ভোগের ইচ্ছা কাটিয়ে পরমেশ্বরীর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পথ দেখায় পঞ্চ ম কার সাধনা ৷ পশুপ্রবৃত্তি সম্পন্ন মানুষ এতে সম্যক জ্ঞান পায় ৷ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বলেছেন ,” যখন সংসারে মন থাকে তখন লিঙ্গ , গুহ্য ও নাভি মনের বাসস্থান ৷ মনের চতুর্থ ভূমি হৃদয় ৷ তখন হয় প্রথম চৈতন্য বা চেতনা লাভ ৷তখন আর নিচের দিকে মন যায় না ৷ মনের মধ্যে পঞ্চম ভূমি কন্ঠ ৷ মন কন্ঠে উঠলে ঈশ্বর ছাড়া অন্য কথা শুনতে ও বলতে ভাল লাগে না ৷ মনের ষষ্ঠ ভূমি কপাল ৷ সেখানে অহর্নিশি ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন হয় ৷ শিরোদেশ সপ্তম ভূমি ৷ সেখানে মন গেলে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন মেলে “৷ এর ব্যাখ্যা তান্ত্রিক দিয়েছেন ৷ এটা কালা যাদু বা বিদ্যা নয় ৷ষট্ চক্রভেদে পঞ্চ তত্ত্ব ৷” মদ” -“ব্রহ্মরন্ধ্র হতে যেই সুধা ঝরে অনিবার /পিয়ে মা তে সদানন্দে সেই মদ্যসাধক সার “৷ “সোমধারা ক্ষরেদ্ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ্ বরাননে ৷/ পীত্বা আনন্দময় স্ত্বাং যঃ স এব মদ্য সাধক “৷ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে নিঃসৃত অমৃত ধারা হল পঞ্চ ম কারের “মদ” ৷ “মাংস”- “মা শব্দে রসনা বোঝ , বাক্য তারই অংশ হয় ,/ সেই বাক্য রসনার অতি প্রিয় সুনিশ্চয় ,/ সেই বাক্য ভক্ষণ করে বাকসংযত যেই ,/নির্বাক সেই মহাসাধু মাংসের সাধক সেই “৷ মহাদেব স্বয়ং বলেছেন ,” মা শব্দাদ্ রসনা জ্ঞেয়া তদ্ অংশান রসনাপ্রিয়ে ৷/ সদা যো ভক্ষয়েৎ দেবী স এব মাংস সাধকঃ”৷ নিজের সমস্ত সৎকাজে ফল নিষ্কল পরমব্রহ্মে সমর্পণ হল মাংস সাধন ৷ “মাছ” – “ইড়া পিঙ্গলা ও সুষমার ত্রিবেণীতে /যে সাধক সাঁতরে থাকে সুস্থ্য চিতে ,/ সে সাধক জানিবে ব্রহ্মময়ীর বৎস / সাধনায় সিদ্ধ হয়ে হয়েছে মৎস্য “৷ এ প্রসঙ্গে ভগবান শিব বলেছেন ,” গঙ্গা যমুন্যোর্মধ্যে মৎসৌ দ্বৈ চরতঃ সদা ৷/ তৌ মৎসৌ ভক্ষয়েদ যস্তু স ভবেৎ মৎস্য সাধকঃ “৷ যিনি কুম্ভকের সহায়তায় গঙ্গা যমুনার বা আধ্যাত্মিক মতে ঈড়া পিঙ্গলা নাড়ীকে পুষ্টি সাধন করে প্রাণের গতি সুষুম্না নাড়ীতে চালনা করতে পারেন তিনি মৎস্য সাধক ৷”মৎস্যমানং সর্ব্বভূতে সুখদুঃখম্ ইদম্ প্রিয়ে ৷/ ইতি যৎ সাত্ত্বিকং জ্ঞানং তৎ মৎস্য পরিকীর্তিতঃ”৷ তখন দুঃখ ও সুখের ভেদ লুপ্ত হয় ৷ “মুদ্রা” প্রসঙ্গে তন্ত্রের উদগাতা শিব বলেছেন ,” সহস্রারে মহাপদ্মে কর্ণিকামুদ্রিতাচরেৎ / আত্মা তত্রৈব দেবেশি কেবলঃ পারদোপমঃ৷/ সূর্য্যকোটী প্রতীকাশ চন্দ্রকোটী সুশীতলঃ / অতীব কমনীয়শ্চ মহাকুন্ডলীযুতঃ/যস্য জ্ঞানোদয়স্তত্র মুদ্রাসাধক উচ্যতে”৷ মানুষের মাথার সহস্রদল পদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকার ভিতরে থাকে পারদশিবলিঙ্গ তুল্য আত্মা ৷ যা অতীব মনোহর ,স্নিদ্ধ ও তেজদীপ্ত ৷যে সাধক এই জ্ঞান পান তিনি মুদ্রা সাধক ৷ সৎসঙ্গে মুক্তি আর অসৎসঙ্গে বন্ধন এই জ্ঞান প্রাপ্ত হন ৷ “মৈথুন” – “মৈথুন পরম তত্ত্ব সৃষ্টি -স্থিতি -প্রলয় কারণ ,/ ব্রহ্ম আর তাঁর শক্তির নাইকো বারণ ,/ তাহাতে হইলে সিদ্ধি সুদুর্লভ লভে ব্রহ্মজ্ঞান / এই মৈথুনে রত যেই সে মৈথুনের সাধক প্রধান “৷তাই দেবাদিদেব বলেছেন ,” মৈথুনং পরমং তত্ত্বং সৃষ্টি স্থিতি অন্ত কারণম্ ৷/ মৈথুনাৎ জায়তে সিদ্ধিব্রর্হ্মজ্ঞানম্ সুদুর্লভং ৷৷/ কুলকুন্ডলিনীশক্তির্দেহিনাং দেহধারিণী ৷/ তয়া শিবস্য সংযোগো মৈথুনং পরিকীর্তিতম্ “৷এই সাধক কুলকুন্ডলিনী শক্তি জাগ্রত করে ষটচক্র ভেদ করে পরমশিবের সঙ্গে মিলন ঘটাতে পারেন ৷ প্রতীকীভাবে স্থুল মৈথুনের মত মাতৃকাদি , ঋষ্যাদি ও তত্ত্বাদি ন্যাস আলিঙ্গন ৷ ইষ্ট দেবদেবীর ধ্যান হল চুম্বন ৷ ইষ্ট দেবদেবীর আবাহন হল শীৎকার , তাঁর উদ্দেশ্যে নৈবেদ্যকে বলা হয় অনুলেপন এছাড়া জপকে রমণ এবং দক্ষিণাদানকে রেতঃপাত বলা হয়েছে ৷ এভাবে বর্ণনা করে “ষড়ঙ্গসাধন” কে গোপনীয় অনেক ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করে তোলায় অসৎ মানুষ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য না বুঝিয়ে অন্যায় কাজকে পঞ্চ ম কার বলে চালায় ৷ ভোগ লালসা চরিতার্থ করে মানুষকে ঠকায় ৷ নিজে সাধন চ্যুত হয় ৷
আসলে মদ – ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে আসা অমৃতধারা ৷মা মা করতে করতে মায়ের নেশা ৷ মাংস – শিশু থেকে বৃদ্ধা এই মাতৃজাতির মধ্যে মায়ের উপলব্ধি ৷মাছ- সুষুম্না হলো সরস্বতী নদী ৷ ইড়া ও পিঙ্গলা এই নদীর দুটি মাছ ৷ নাড়ী দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস যায় , যা মাকে সমার্পন ৷মুদ্রা – ঐশ্বর্য ৷মা কে পেলে বাকি ঐশ্বর্য লাভের ইচ্ছা দূর হয় ৷মৈথুন – নারী- পুরুষের মিলন নয় ৷ গুরুর কাছে এই ধ্যান শিখলে মন মৈথুনের চেয়েও আনন্দে ভরে যায় ৷ আমাদের দেহের মধ্যেই আছে সব উপভোগ্য সামগ্রী ৷ পঞ্চ ম-কারে সেই উপভোগ্য সব সামগ্রী ঈশ্বরের কাছে সমার্পণ করতে হয় বাইরের মদ , মাংস , মাছ , মুদ্রা ও মৈথুন নয় ৷ ওটা প্রতীকী ব্যাখ্যা ৷ আশাকরি , কারো ভুল ধারণা থাকলে এবারে বুঝবেন ৷ রামপ্রসাদ তাই গেয়েছেন ,”ধর্মা ধর্ম হল প্রচন্ড স্বরূপ / পুণ্যক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ …”৷ জয় মা কালী তুমি ভক্তি দাও ৷ সদানন্দময়ীর আনন্দে যেন আপ্লুত হতে পারি ৷ জয় মা কালী ৷

More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.