জন্মদিনে স্মরণঃ রা খা ল দা স ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য : সেদিন বহরমপুরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বহরমপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কর্তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কর্ণসুবর্ণ এলাকার বাসিন্দা এক দিনমজুর। উঠোনে দাঁড়িয়ে কর্তা তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। হঠাৎ কর্তার নজর গেল দিনমজুর লোকটির কাদা-মাখা পায়ের দিকে। লালচে রঙের কাদা। কর্তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি নিজে হাতে সেই কাদা চেঁচে একটা কাগজে সংগ্রহ করলেন। তারপর সেটি পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায় আর্কিওলজি অফ ইন্ডিয়াতে। সেখানে পরীক্ষায় প্রমাণিত হল কর্তার ধারণা একদম ঠিক। ওই কাদা আসলে ষষ্ঠ শতকের রাজা শশাঙ্কের আমলের নিদর্শন। কর্তার নাম রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার কৃতিত্বকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বহু বছর ধরে। জওহরলাল নেহরু তার ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইতে মহেঞ্জোদরোর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব পুরোটাই দিয়েছেন জন মার্শালকে। নামও নেই রাখালদাসবাবুর। কর্মজীবনে মূর্তি চুরির মিথ্যা অভিযোগে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাকরি থেকে বরখাস্তও করা হয়েছিল।
তখন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে উড়িষ্যার হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছে। দায়িত্বে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় ওখান থেকে মূল্যবান একটি মূর্তি চুরি যায়। বড়কর্তা জন মার্শাল কোন প্রমাণ ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং তাকে বরখাস্ত করেন।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ ও স্কুল থেকে ১৯০০ সালে এনট্রান্স পাস করেন। ১৯০৩ সালে এফ.এ পাস করেন। এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে ইতিহাসে অর্নাস ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে এম.এ পাশ করেন। চাকরি পান ভারতীয় যাদুঘরের আর্কিওলজিক্যাল বিভাগে।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের ডিরেক্টর জেনারেল স্যর জন মার্শাল রাখালদাসের কাজকর্ম দেখে একেবারে মুগ্ধ। পরের বছরেই তাকে সার্ভের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট করে দিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট থেকে ১৯০৭ সালে ওয়েস্টার্ন সার্কেলের সুপার হয়ে চলে গেলেন পুণে অফিসে।
এই সময়ে তিনি গ্রিক বিজয় স্তম্ভের সন্ধানে সিন্ধু অঞ্চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে উৎখননকালে তিনি এমন কতগুলি নিদর্শনের সন্ধান পান যা তাকে হরপ্পায় সাহানী কর্তৃক প্রাপ্ত অনুরূপ নিদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সভ্যতাই ছিল মহেঞ্জোদারো সভ্যতা। মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সুপ্রাচীন ধংসাবশেষ আবিষ্কার তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
তিনিই প্রথম আদি বাংলা লিপির প্রতি পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আদি বাংলা লিপিই পরবর্তীকালে বাংলা লিপির রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত তার Memoir of the Asiatic Society of Bengal-এ প্রকাশিত হাতিগুমফা ও নানাঘাট অভিলেখের প্রাচীন হস্তলিপি গ্রন্থখানি ভারতীয় হস্তলিপি বিদ্যার গবেষণার ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে চিহ্নিত।
মূর্তিতত্ত্বে রাখালদাসের গভীর অনুরাগ ছিল। তিনি তার Eastern Indian Medieval School of Sculpture-এ বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর মূর্তি শনাক্ত করেন এবং পৌরাণিক কাহিনি ও যথার্থ উদাহরণসহ পাল-সেন যুগের ধ্যানমগ্ন মূর্তির ব্যাখ্যা দেন।
তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ‘২ খন্ডে বাঙ্গালার ইতিহাস’, ‘পাষাণের কথা’, ‘ত্রিপুরী হহৈয় জাতীর ইতিহাস’, ‘করুণা’, ‘ব্যতিক্রম’, ‘অসীম’, ‘পক্ষান্তর’, ‘ভূমারার শৈবমন্দির’, ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’, ‘প্রাচীন মুদ্রা’ ইত্যাদি।
১৯৩০ সালের ২৩ মে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৫ সালের আজকের দিনে (১২ এপ্রিল) মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কালিমাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment