Press "Enter" to skip to content

ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা….।

Spread the love

” রথযাত্রা (RATHA YATRA ) ”
——————————————-
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ৩০ জুন ২০২২। আগামীকাল শুক্রবার ১৬ আষাঢ় ১৪২৯  (১ লা জুলাই ২০২২ ) শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে সারা বিশ্বজুড়ে হবে
ভগবান শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। আর একাদশী তিথিতে( এবারে ৯জুলাই ২০২২ বা ২৪ আষাঢ় ১৪২৯) হবে পুনর্যাত্রা বা বহুড়াযাত্রা বা উল্টোরথ ৷ যার প্রধান আকর্ষণ শ্রীক্ষেত্র পুরী ধাম ৷ জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে গুন্ডিচা মন্দির বা মৌসিমা মন্দিরে বা মাসীর বাড়ীতে রথযাত্রা শেষ হয়

ছবিটি পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরের ৷ যার সূচনা তৎকালীন মালব বা অধুনা উড়িষ্যার সূর্যবংশীয় পরম বৈষ্ণব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর হাতে ৷পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীতে রথে ভগবানের শ্রীবিগ্রহ দেখলে পরকালে
জন্মান্তর চক্রে না পড়ে বৈকুন্ঠ লাভ হয় ৷ শাস্ত্রে আছে ,” রথস্থ বামনং দৃষ্টাপুনর্জন্ম ন বিদ্যতে “৷ বৃহন্নারদীয় পুরাণে তাই বলা হয়েছে ,
“প্রতিমাং তত্রতাং দৃষ্টা স্বয়ং দেবেন নির্মীতম ৷ অনায়াসেন বৈজান্তি ভবনং মে তত নরাঃ ৷
অর্ধসমাপ্ত মূর্তি হলেও তিনি পরমেশ্বর ৷ আসলে ভগবান “অবাঙমানসগোচর” ৷ তাঁকে রূপে কল্পনা
শুধু সহজে কাছের জন হিসাবে তাঁর সান্নিধ্য পেতে ৷পরমাত্মা আমাদের অন্তরে আত্মারূপে বিরাজমান ৷আমাদের দেহ হল রথ আর আত্মা দেহের রথী ৷
” না আত্মানং রথিনংবিদ্ধি শরীরং রথমেবতু “( কঠোপনিষদ ) ৷তাই কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতর
উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে লেখা আছে –
” অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতা
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ ৷
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্ ৷৷” মানে তাঁর লৌকিক হাত না থাকলেও তিনি সবকিছু গ্রহণ করেন ৷ আবার পা দেখা না গেলেও সবর্ত্র চলেন ৷ তাঁর চোখ না থেকেও সবকিছু তাঁর দৃষ্টিগোচরে আছে ৷

আমরা তাঁর কান দেখতে পাই না ৷ কিন্তু , তিনি সবকিছু শুনতে পান ৷ এই তত্ত্বই নুলো জগন্নাথ মূর্তিতে ৷ “স্কন্ধপুরাণ ,””ব্রহ্মান্ডপুরাণ ” ও “পদ্মপুরাণ ” এ মহাকালের প্রতীক রথের কথা আছে ৷ স্কন্ধপুরাণের “পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য ” তে মহর্ষি জৈমিনী রথের আকার , সাজসজ্জা ও পরিমাপের যে বর্ণনা দিয়েছেন সে অনুযায়ী আজও পুরীতে রথ হয় ৷ এবার বলি রথযাত্রার আগের ইতিহাস ৷সনাতনী বিশ্বাস অনুযায়ী
বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া বা অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সত্যযুগ শেষ হয় ত্রেতা যুগ শুরু হয় ৷
এদিন থেকে শুরু হয় জগন্নাথদেবের সর্বাঙ্গে সুগন্ধি চন্দন লেপন ৷ যাকে বলে “চন্দন যাত্রা ” ৷২১দিন ধরে চন্দনের ঠান্ডা গুণ ভগবানকে আনন্দ দেয় ৷এরপর ১০৮ঘড়া জল ঢেলে হয় ভগবানের “স্নানযাত্রা” উৎসব ৷ জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথির স্নানযাত্রার বা দেবস্নানা পূর্ণিমা তিথিটিই জগন্নাথদেবের আবির্ভাবের দিন ৷ স্বয়ম্ভু মনুর যজ্ঞের প্রভাবে ঐদিন তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ৷ স্নানযাত্রার পর প্রভুর জ্বর হয় ৷১৪দিন তিনি কোয়ারান্টিনে থাকেন ৷ বন্ধ থাকে ভক্তদের জন্য তাঁর দর্শন ৷ ঐসময়টাকে বলে আনাসারা বা অনবসর ৷এই কাল কাটলে হয় রথযাত্রা ৷ পুরীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেব প্রতিবছর নব রথে ওঠেন । নব শব্দের এখানে দুটি অর্থ নতুন ও নববিধা ভক্তি। মানে ভক্তির রথ। ভক্তি দিয়ে গড়া রথ। তাই রথে এলেই মনে পড়ে সেই শ্যামাসঙ্গীতটি ,” আমি রথ তুমি রথী , যেমন চালাও তেমনি চলি “৷ আমার কাছে শ্যামা আর শ্যাম বা জগন্নাথ ও ভগবতী একাকার হয়ে যায় ৷ রথের দড়ি – বাসুকি নাগ বা “শঙ্খচূড়া নাগুনি “৷ তাই , রথের রশি বা দড়ি ধরে টানলে বাসুকির কৃপা লাভ হয়।
পুরীর রথের ৪২ টি চাকা। (দাদা বলভদ্র বা বলদেবের রথের ১৪ টি, জগন্নাথের রথের ১৬ টি, বোন সুভদ্রাদেবীর ১২ টি)।
পুরীর রথ চলার সময় রাস্তায় চাকার তিনটি দাগ পড়ে – তা হল গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী। যারা বার্ধক্যজনিত কারণে বা অন্যান্য কারণে ভীড়ে রথের দড়ি ধরতে পারেন না, কথিত আছে তারা যদি চাকার এই তিনটি দাগের ধুলি গ্রহণ করেন, বা এই ত্রিদাগে গড়াগড়ি দেন, যাতে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী সঙ্গমে অবগাহন স্নানের পূণ্য- ফল লাভ হয় ।


জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ বা কপিধ্বজ বা গুরুড়ধ্বজ । ৪৫ ফুট উচ্চতার এই রথের ১৬টি চাকা। রথের রঙ পীত বা হলুদ । ষোল চাকা মানে দশ ইন্দ্রিয় আর ষড় রিপু । তাই থাকে জগন্নাথদেবের পায়ের নীচে।
নীল রঙের বলরাম বা বলভদ্রের রথের নাম হল তালধ্বজ বা হলধ্বজ বা লাঙ্গলধ্বজ । ৪৪ ফুট উচ্চতার এই রথে ১৪টি চাকা আছে। ১৪টি চাকা মানে ১৪ ভুবন। বলভদ্র হল গুরুতত্ত্ব। গুরুতত্ত্বের অধীন ১৪ ভুবন।
সুভদ্রার রথের নাম ‘দর্পদলন’ বা “দেবদলন” বা ‘পদ্মধ্বজ’। লাল রঙের দেবতাদের দেওয়া এই রথের উচ্চতা ৩১ হাত বা ৪৩ ফুট । রথটিতে ১২ টি চাকা আছে। ঈশ্বর ভজনার কোন বিশেষ সময় হয় না ৷ যা করতে হয় বার মাস ৩৬৫ দিন সবসময় ।
রথগুলি যেহেতু কোনরকম আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়া শুধুমাত্র কাঠের তৈরি, ফলে রথ চলার সময় কাঠের ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, এটিকে বলা হয় বেদ।
জগন্নাথের রথ তৈরীতে ২০৬ টি কাঠ লাগে ৷ যেমন আমাদের দেহেও ২০৬ টি হাড়।
সবার বজ বলরাম তাই রথ যখন চলে প্রথমে থাকে দাদা বলদেবের রথ।আসলে তা গুরুর মাহাত্ম্য বা গুরুতত্ত্ব। তিনিই তো নিত্যানন্দ ।সবার জীবনে আগে গুরুকৃপা আসতে হবে।
এরপর যায় সুভদ্রার রথ। সুভদ্রা হল ভক্তি তত্ত্ব। গুরুকৃপা পেলে ভক্তি দৃঢ় হয় ৷ পাওয়া যায় ভক্তিমহারাণী সুভদ্রাকে ।


সবশেষে যায় জগন্নাথের রথ। গুরুর কৃপা থেকে ভক্তির উদয় হলে তবে পাওয়া যায় বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মালিক ভগবান জগন্নাথকে ৷মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব যেমন অপলক নয়নে বিভোর হয়ে রথে অবস্থিত জগন্নাথকে দেখতেন এবং আনন্দে নাচতেন সেভাবেই ভক্তকে হৃদয় দিয়ে ভগবানকে দেখতে হয় ও প্রণতি জানাতে হয় ৷ ভক্তেকে দেখার জন্য ভগবানও আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করেন ৷ পুরীতে নেই কোন জাতি বা বর্ণভেদ ৷ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই যোগ হলো রথ দর্শন ৷রথযাত্রা উচ্চ-নীচ , ধনী-গরিব , নারী -পুরুষ সবরকম ভেদাভেদ ভুলে মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীভাব জাগায় এবং সবাইকে নিয়ে একসাথে বাঁচতে শেখায় ৷ সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এই লেখকের লেখা “সনাতনী কৃষ্টিকথা” বইটি পড়ুন৷ হিন্দু ধর্মের অন্তনির্হিত তাৎপর্য অনুধাবন করুন ৷

পুরী ছাড়াও উড়িষ্যার বহু শহরে , পশ্চিমবঙ্গের
মাহেশ , মহিমাদল , গুপ্তিপাড়া , বাংলাদেশের ধামরাইয়ের রথ সুপ্রাচীন ও বিখ্যাত ৷ আর এখন পৃথিবীর সব বড় শহরে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ৷
মুখে বলুন জগন্নাথ , বলরাম ও সুভদ্রার জয় ৷ প্রভু জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে ৷জয়তু রথযাত্রা ৷

More from CultureMore posts in Culture »
More from GeneralMore posts in General »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.