“রাস লীলা” !
——————-
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ১৮, নভেম্বর, ২০২১। “রাস ” ভক্তের সঙ্গে ভগবানের বা পরমাত্মার সাথে
আত্মার মহামিলন ৷ যাতে দৈনন্দিন জীবনের সুখানুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় এবং কাম প্রবৃত্তি সমূহকে প্রেমাত্মক প্রকৃতিতে রূপ দেওয়া হয় ৷”র” হলো ভক্ত আর “স” হলেন ভগবান ৷ “রস” শব্দের প্রথম অক্ষরের সাথে “আ” ( আকর্ষণ) যোগ হয়ে হয় “রাস ” ৷ আবার “র” – রাধারাণী , “আ” – জাগতিক কামনা ,”স” -ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৷ এই “আ” হলো আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনে বাধা ৷ তাই আমাদের মধ্যে যেন কাম ভাব না আসে ৷ এলে নিজের কাম নিজের ভিতর দমন করি ৷৬৪ লীলার সেরা দুর্গাপুজোর পরের পূর্ণিমার “রাস পূর্ণিমা “৷ যাকে তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২/৭) বলেছে রসো বৈ সঃ ৷ আসলে এ রস ব্রহ্মরস ৷ রস হলো আনন্দ , দিব্যপ্রেম বা অনুভূতি ৷ ” রাসো নাম বহু নত্তর্কী যুক্তে নৃত্য বিশেষঃ”৷
এই বৃত্তাকারে নাচ যা ৮,১৬, বা ৩২ জনে মিলিত
ভাবে উপস্থাপন করে ৷এটা কাম রস হীন ধ্রুপদী নৃত্য ৷যাকে তাল যুক্ত হল্লিশ নাচ বলে ৷”নৃত্যগীত চুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসনাং সমূহ রাসন্তন্ময়ী যা ক্রীড়া “৷ রসকে আকর্ষন করে “রাস” ৷ রস পাঁচ রকম -শান্ত , দাস্য , সখ্য , বাৎসল্য ও মধুর রস ৷ রাস দু’রকম – নিত্য রাস ও মহারাস ৷ কাল অনুযায়ী রাস দুবার হয় ৷ চৈত্র পূর্ণিমায় বলদেবের”বাসন্তী রাস ” ৷
আর এখন কার্তিক পূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণের ” শারদ রাস ” ৷ বৃন্দাবনের গোপীরা কৃষ্ণকে পতি রূপে পেতে কামদেবী কাত্যায়ণী ব্রত করলে ভগবান কার্তিক পূর্ণিমায় তাঁদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা দেন ৷ ভগবত পুরাণের পঞ্চম অধ্যায়ে কৃষ্ণ অভিসারে রাধা , গোষ্ঠী অভিসার , গোপীদের রাগ আলাপ , কৃষ্ণর্তন , রাধা নর্তন , গোপীদের নর্তন , কৃষ্ণের অন্তর্ধান ও ফিরে আসা , গহগমণ ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায় বর্ণিত হয়েছে মহারাস প্রসঙ্গে ৷গোপী তিন প্রকার ৷ রাধারাণী ও অষ্ট সখী ( ললিতা , বিশাখা , চিত্রা , ইন্দুরেখা , চম্পকলতা , রঙ্গদেবী , তুঙ্গদেবী ও সুদেবী ) হলেন “নিত্যসিদ্ধা গোপিনী ৷ আর “সাধনসিদ্ধ গোপিণীরা ” ত্রেতা যুগে ছিলেন বালখিল্য মুনি ৷ তাঁরা রামচন্দ্রের রূপে মোহিত হয়েছিলেন ৷ কিন্তু , রাম অবতারে ভগবান শুধু সীতাকে নিয়ে থাকবেন ৷ তাই দীর্ঘ তপস্যায় পরজন্মে তাঁরা পরের অবতার নন্দ মহারাজের পুত্র কৃষ্ণকে রাস পূর্ণিমার দিন পতি রূপে পান ৷ আর দামোদর মাসে কাত্যায়ণী ব্রত করে যাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে এক রাতের জন্য পতিরূপে পেতে চেয়েছিলেন তাঁরা হলেন “কৃপাসিদ্ধ গোপী “৷ আমরা জানি শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর ধরাধামে ছিলন ৷ আর নিধু বনে শ্রীকৃষ্ণ বংশী ধ্বনি করে যখন গোপিনীদের ডাকেন তখন তিনি মাত্র ৭ বছর ৩ মাস বয়সের শিশু অথচ ঐ শিশুকে পতি রূপে পেতে যে যেভাবে ছিলেন সেভাবে ভগবানের কাছে ছুটে আসেন ৷একই সাথে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা বা যতজন গোপী ততজন কৃষ্ণ রয়ে অর্থাৎ ১৬০০০ প্রাসাদে একই সময়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গ দিলেন !একই কৃষ্ণ বিভিন্ন হয়ে সবার সাথে নৃত্য করেছিলেন ৷ এখানেই বোঝা যায় তিনি মানুষ নন ৷ স্বয়ং ভগবান ৷ এই রাসলীলা তাই দৈবিক কার্য্য divine act. এ প্রেম ভালোবাসা শারীরিক চাহিদা নয় প্ল্যাটোনিক আধ্যাত্মিক মিলনের তিতিক্ষা ৷ স্বর্গীয় আনন্দ তথা পরমানন্দ ecstasy.”অনঙ্গ” মানে “কাম” হলেও আধ্যাত্মিক অর্থ ভগবানের কাছ থেকে আনন্দ পেতে বা দিতে চাওয়া বোঝায় ৷রাসলীলায় ভগবান হলেন মদনজয়ী মদনমোহন ৷যোগমায়া সেই মত
প্রকৃতিকে মোহিনীরূপে সাজিয়ে ছিলেন ৷ আবার যোগমায়ার কৃপায় গোপিনীরা রাসের পর ঘরে ফিরে গেলেও কোন অসুবিধার সম্মুখীন হন নি ৷ব্রহ্মার এক পলক, সারা রাত ধরে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গ দেন ৷ তিনি বৈজয়ন্তী মালা ধারন করে প্রত্যেকে গোপিনীর কাছে গিয়ে নৃত্য করতে থাকেন ৷ সেই “হল্লিক নৃত্যই ” – রাসলীলা ৷ যে নাচকে বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল নাচ গুরুত্ব দিয়েছে ৷ স্বয়ং ভগবানের সান্নিধ্য লাভের অহংকারে বা কৃষ্ণ একান্ত নিজের ভাবার জন্য ভগবান রাসকুঞ্জ থেকে অন্তর্হিত হলেন ৷ তখন শ্রীরাধা “রাই রাজা” সেজে তাদের সঙ্গ দেন ৷ সেটাকে বলে ” ভাঙারাস” ৷ গোপিনী হলেন তাঁরাই যাঁরা নিজেদের পুণ্যফলে শ্রীভগবানকে নিজের করে পেয়েছিল ৷ এর মধ্যে নেই কামনা – বাসনা৷ কৃষ্ণ মন্ডলে মদনদেব দৈহিক কাম জাগানোর চেষ্টা করলে কৃষ্ণ তাঁকে কদম গাছে বেঁধে রাখেন ৷ রাসলীলার কারণ দুটি ৷ কামদেবের অহংকার চূর্ণ করা ও গোপিনীদের মনোবাসনা পূর্ণ করা ৷ তাই , রাস কামের জন্য নয় কামের নিবর্তনের জন্য ৷ গোপিণীরা কামাতুর নয় আসলে ছিলেন জাগতিক আসক্তি শূণ্য ৷ ভাগবতের ২৯-৩৩ এই পাঁচ অধ্যায়ে ভগবানের মাধুর্য্য রাসলীলার বর্ণনা আছে ৷১০ম স্কন্দের ২২তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যিনি ভগবানকে সব দিয়েছেন তাঁর মধ্যে তখন অন্য কামনা বাসনা লুপ্ত হয় ৷ রাসলীলা হলো জগতের পতিকে নিজের পতি মনে করে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ৷ সব জীবের মধ্যে অধ্যক্ষ রূপে শ্রীকৃষ্ণ বিদ্যমান ৷তাই , গোপীরা লজ্জা , ভয় , পরিবার ও পরিজন ছেড়ে নিজেদের সবকিছু কৃষ্ণর কাছে সমর্পণ করেছেন ৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার লীলা বা মিলন ৷ সুতরাং , পুরুষ ও স্ত্রী নির্বিশেষে তিনিই আমাদের একমাত্র কাম্য ৷ ভগবানের রাসলীলাকে নিয়ে কোন কটূ কথা শুনবেন না ৷ অনুরোধ করবেন বিষয়টি ভালোভাবে জেনে মন্তব্য করতে ৷ অপবাদ কারীদের বলবেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিষ্কাম ভক্তি যোগ ভগবৎ প্রেম ৷ আর এই প্রেমের সর্ব্বোচ্চ প্রকাশ “মহারাস “৷ একমাত্র শুদ্ধ ভক্ত তা সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে পারে ৷ শুধু তাঁদের কাছেই বলুন ও তাঁদের কাছ থেকে শুনুন রাসের প্রকৃত তত্ত্বকথা ৷ যাঁরা জাগতিক ঠুলি চোখে পড়ে সব কিছুকে নাটুকে প্রেম ভেবে বা সনাতনী বিশ্বাসকে খাটো করতে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করেন তাঁদের বৈষ্ণবোচিত ভাবে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়ে রাস কি ও কেন বোঝান ৷

বৃন্দাবনে গোস্বামীরা প্রথম “রাস যাত্রা ” উৎসবের সূচনা করেন ৷ সেই ব্রজলীলার অনুকরণে কলির কৃষ্ণ ” শ্রীচৈতন্য” দেবের জন্মস্থান নবদ্বীপে ৫০০ বছর ধরে চলে আসছে এই বৈষ্ণবীয় রাস ৷ পরে পলাশীর যুদ্ধের
আগে নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র হিন্দুদের সব শাখার
সাধু সন্তদের সমর্থনে নবদ্বীপে বৈষ্ণব রাসের পাশা
পাশি চালু করেন শাক্ত ও শৈব দেবদেবীর পুজো ৷
রাস পূর্ণিমা বিশেষ ভাবে পালিত হয় দুই বাংলা ,
ওড়িশা , মণিপুর , ত্রিপুরা , অসম ও উত্তরপ্রদেশে ৷
নবদ্বীপ , শান্তিপুর , দাঁই হাট , কোচবিহার , বলাগড় , সুন্দরবন থেকে সুদূর বাংলাদেশের সৈকত শহর কক্সবাজারের খুরুপকুনে মহাসমারোহে রাস যাত্রা হয় ৷ জয় শ্রীকৃষ্ণ ৷ সবাইকে জানাই রাস পূর্ণিমার আগাম অভিনন্দন৷
Be First to Comment