 ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫।  কার্তিক মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া। আকাশে হেমন্তের নীল আভা, বাতাসে শিউলির গন্ধ। কালীপুজোর আলো মুছে না যেতেই আবার আসে এক অন্য উৎসব—ভাই ফোঁটা। এই দিনটি কেবল রীতি নয়, এটি ভালোবাসা, মমতা ও আশীর্বাদের উজ্জ্বল প্রতীক। দক্ষিণ কলকাতার এক পুরোনো বাড়ি। সুধারাণী দেবীর বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি, তবু তাঁর হাতে কাঁপুনি নেই। আজ ভাই ফোঁটা। উঠোনে আলপনা আঁকা, পেতলের থালায় চন্দন, দই, গঙ্গাজল আর মিষ্টি সাজানো। তাঁর নাতনি মীরা ব্যস্ত প্রস্তুতিতে।
ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫।  কার্তিক মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া। আকাশে হেমন্তের নীল আভা, বাতাসে শিউলির গন্ধ। কালীপুজোর আলো মুছে না যেতেই আবার আসে এক অন্য উৎসব—ভাই ফোঁটা। এই দিনটি কেবল রীতি নয়, এটি ভালোবাসা, মমতা ও আশীর্বাদের উজ্জ্বল প্রতীক। দক্ষিণ কলকাতার এক পুরোনো বাড়ি। সুধারাণী দেবীর বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি, তবু তাঁর হাতে কাঁপুনি নেই। আজ ভাই ফোঁটা। উঠোনে আলপনা আঁকা, পেতলের থালায় চন্দন, দই, গঙ্গাজল আর মিষ্টি সাজানো। তাঁর নাতনি মীরা ব্যস্ত প্রস্তুতিতে।
—ঠাকুমা, তুমি তো বললে তোমার ভাই নেই, তবুও এত আয়োজন কেন?
সুধারাণী হাসলেন নরম হাসি। বললেন, —মীরা, ভাইফোঁটা কেবল ভাইয়ের কপালে চন্দন দেওয়া নয়; এটি সম্পর্কের পবিত্রতার উৎসব। আমার ভাই চলে গেছে বহুদিন, কিন্তু মনে হয়, আজও সে কোথাও আছে—এই ফোঁটার আলোয়, এই মন্ত্রের ধ্বনিতে।
ঠিক তখনই দরজায় দাঁড়িয়ে এক কিশোর রুদ্র। পরনে পুরোনো জামা, হাতে একগোছা শিউলি ফুল। সুধারাণীই তাকে পড়তে সাহায্য করতেন। মীরা হেসে বলল,
—আজ থেকে তুই আমার ভাই, রুদ্র ! আয় ,, তোর কপালেই প্রথম ফোঁটা পড়বে।
রুদ্র অবাক হয়ে বসে পড়ল। মীরা মন্ত্র পড়ল—
“যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ুক কাঁটা।”
চন্দনের ঠান্ডা স্পর্শে রুদ্রের চোখে জল আসে। জীবনে প্রথমবার সে অনুভব করে, কেউ তাকে ভালোবেসেছে।
দিল্লির ভাই দোজ / ভাই দুজ
দূর দিল্লিতে অফিসে বসে আছে অর্পিতা। টেবিলের পাশে ভিডিও কলে কলকাতার অভিরূপ—তার ছোট ভাই। আজ তাদেরও ভাই দোজ।
অর্পিতা নিজের বানানো পুরি ও হালুয়া খুলে বলে—
—দেখ, আজ তোর নামে বানিয়েছি।
অভিরূপ হেসে বলে,
—তুই খা, দিদি, তোর মুখ দেখেই আমার পেট ভরে যায়।দু’জনের মধ্যে শত মাইল দূরত্ব, তবুও এই দিনের বন্ধন অটুট। স্ক্রিনের ওপারে হাসি, চোখে জল, আর এক অদৃশ্য ফোঁটার আলো ছড়িয়ে পড়ে।
পুনের ভাইবিজ
পুনের এক কলেজপড়ুয়া মেয়ে সায়লি আজ খুব ব্যস্ত। তার ভাই অদ্বৈত অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। রান্নাঘরে দুধে এলাচের গন্ধ, হাঁড়িতে ফুটছে “বাসুন্দি”—মহারাষ্ট্রের ভাইবিজ-এর অপরিহার্য মিষ্টান্ন।
সায়লি হাসতে হাসতে বলে,
—ভাই, আজ কোনো কাজ নয়, আজ তুই শুধু হাসবি।
অদ্বৈত হেসে উত্তর দেয়,
—তুই হাসলেই আমি বেঁচে যাই, সায়লি।
ফোঁটার পর সায়লি ছোট প্যাকেটে উপহার দেয়—নিজের হাতে বোনা রাখি আর একখানা চিরকুটে লেখা,
“তুই থাকলেই আমার আকাশে রোদ ওঠে।”
বেঙ্গালুরুর যম দ্বিতীয়া
বেঙ্গালুরুর এক শান্ত পাড়ায় রাধিকা ও অর্জুনের ঘরে উৎসবের রঙ। রান্নাঘরে দইভাত, পায়াসম, নারকেলের বরফি।
রাধিকা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে বলে—
—ভগবান যম ও যমুনার মতো আমাদেরও রক্ষা করুক।
অর্জুন মজা করে উত্তর দেয়,
—তুইই তো আমার যমুনা, দিদি।
তাদের মা একপাশে বসে দেখছেন—চোখে জল, মুখে হাসি। ভাবছেন, যত যুগ পাল্টাক, ভাই-বোনের স্নেহ বদলায় না।
নেপালের ভাই টিকা
কাঠমান্ডুর পাহাড়ঘেরা বাড়িতে অনুরাধা ও সুরজ বসে আছে একসঙ্গে। সাতরঙা টিকায় রাঙা কপাল, ফুলের গন্ধে ভরে গেছে ঘর।
অনুরাধা বলে—
—এই সাত রঙ মানে সাত কামনা—আনন্দ, সাহস, জ্ঞান, প্রেম, শান্তি, স্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু।
সুরজ হেসে বলে— তুই থাকলেই আমার সব রঙ পূর্ণ হয়, দিদি।
তাদের হাসিতে যেন পাহাড়ের বাতাসে রংধনু ঝুলে পড়ে।
সন্ধ্যার নাট্যমঞ্চ — ‘ফোঁটার আলো’
সন্ধ্যায় কলকাতায় মীরা ও রুদ্রের পাড়ায় শুরু হলো ছোট্ট নাটক—“ফোঁটার আলো”।
চরিত্রগুলো এসেছে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে—দিল্লির অর্পিতা, পুনের সায়লি, বেঙ্গালুরুর রাধিকা, নেপালের অনুরাধা।
সবাই একসঙ্গে উচ্চারণ করে—
> “ভাষা ভিন্ন, পোশাক ভিন্ন,
তবু হৃদয়ের সুর এক।
ফোঁটার আলোয় মুছে যায় দূরত্ব,
মিলেমিশে যায় মানবতার রঙ।”
শেষ দৃশ্যে মীরা রুদ্রকে ফোঁটা দেয়। বলে—
—এই ফোঁটা শুধু তোমার নয়, পৃথিবীর সব ভাইয়ের জন্য।
রুদ্র প্রণাম করে বলে—
—দিদি, আজ বুঝলাম, ভালোবাসার ধর্ম নেই—শুধু আলোর পথ আছে।
সুধারাণী দেবী দূর থেকে দেখছেন। তাঁর মুখে প্রশান্তি। ধূপের ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে সন্ধ্যাতারার দিকে। তিনি মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলেন—
“যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ুক কাঁটা।”
আকাশে উঠেছে কার্তিকের চাঁদ, বাতাসে বাজছে সানাইয়ের মতো নরম সুর। ভাই ফোঁটা, ভাই দোজ, ভাইবিজ, যম দ্বিতীয়া, ভাই টিকা—সব মিলেমিশে গেছে এক সুরে, এক ভালোবাসার দীপ্তিতে।
সুধারাণী দেবীর চোখ বুজে আসে। মনে মনে তিনি বলেন—
—এই হলো আমাদের সনাতনী ভারতবর্ষ ,যেখানে ভালোবাসাই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।
উপসংহার
ভাই ফোঁটার এই ফোঁটা কেবল কপালে নয়—এ আলো ছুঁয়ে যায় মন, ছুঁয়ে যায় মানবতার গভীরতম স্তর।
প্রতিটি দিদির আশীর্বাদ আর প্রতিটি ভাইয়ের প্রতিশ্রুতিতে জ্বলে ওঠে সেই চিরন্তন মন্ত্র—
> “ফোঁটার আলোয় দূর হোক অন্ধকার,
আসুক জীবন, আসুক শান্তি।”













Be First to Comment