ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত মায়া-শিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। ৩০, জানুয়ারি, ২০২১। “সকল শিশু ঘুমিয়ে আছে, সব পিতারই অন্তরে” ম্যাজিক নাকি বাচ্চাদের জন্য? ঠিক বলেছেন! এটা একেবারে খাঁটি সত্যিকথা। এই চারদিকের দু-নম্বরীর বাজারে , এই অ্যাদ্দিনে একখানা, বেমানান কিন্তু কি বিশুদ্ধ বাণীটাই না আপনি কপচালেন। আ -হা -হা । কত্তোদিন পর আবার সত্যযুগের এক নীরেট মধুর বচন তরল হয়ে, ড্রপারে সাহায্যে কানের ভিতর দিয়া, পশিলো মম পরাণে। বলুন ভাই, আর একবার বলুন, এবার ধন্য করি মোর আরেকটি কান। মাথাটা ঘুড়িয়ে বসি, ও কানটা এগিয়ে।... আ-হাহা-হা ।"... যে-জন এই 'ফোড়নে' -ভজে, সে হয় আমার প্রাণ রে.."
আপনি নিশ্চয়ই বাঙালি ? কি ? ঠিক ধরি নি ? যাব্বে কোথায় বাওয়া ? !! দেখেই চিনেছি, এক্কেবারে সবজান্তার ঘন জমাটি-ক্ষীরের মডেল । জিরণ খেজুর কাঠের রস ফোটানো পাটালী! সর্বঘটের কলা, জাতে কাঁঠালী ! বিষ-ফোড়ন-পণ্ডিত! আর কতো বলবো ? ডিক্সোনারি-চলন্তিকার চলন্ত এক মনুষ্যের স্থবির -সংস্করণ!
“জাইনলাম ক্যামনে ? আরে মূর্খ, হেইডাও কওন লাইগবো ? ভুইল্যা গেছস্ !!! হুঁ – হুঁ বাবা, মনে নাই? আমিও হালা বাঙালি। অ্যাক্কেবারে কাঠ বাঙাল। ” অতনে অতন চেনে, চোরে চেনে পুলিশ; আমিও তোমাগো চিনি, খাপ্ নাহি খুলিস্ !” এটা স্বয়ং সুকান্ত ভট্টাচার্য্যি তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্যের ভূমিকায় লিখে গেছেন, সেই, ক-ত্তো দিন আগে। কেউ দাম দিলোনা, মাইরী।
ম্যাজিক হচ্ছে অসম্ভবের বাস্তবীকরনের ইচ্ছাপূরণধর্মি এক নাট্যরূপ। অর্থাৎ, বাস্তবে যা ঘটা সম্ভব নয়, সে-সব ইচ্ছেকে বাস্তবে নাকের ডগায় ঘটিয়ে দেখানোই হচ্ছে ম্যাজিক। এ হলো, বিজ্ঞানের সীমানার বাইরের এক দৃশ্যকাব্য। এর পূষ্পাঞ্জলী দিয়েই তৎক্ষণাৎ প্রসাদের দাবীদার অনেক, কিন্তু প্রকৃত সাধক হয় খুব কম। যে কোনও ঘটনা ঘটার পেছনের কার্য্য-কারণ জানা থাকলে আমরা তাকে বলি বিজ্ঞানের কাজ। মানে, আমাদের জ্ঞানের আওতার ভেতরের ব্যাপার। কিন্তু ঘটনাটা ঘটছে, কিন্তু কীভাবে ঘটছে, সেটা জানা না থাকলে বলি 'ম্যাজিক'! খুব সহজ ব্যাপার, তাই না? আমি এর একটা সংজ্ঞা তৈরি করেছিলাম। প্রথম প্রথম কু-যুক্তিবাদীরা এর বিরুদ্ধে খুব গলা ফাটিয়ে, চিল্লামিল্লি শুরু করে ছিলো, কিন্তু চেতনা জাগতে করছেন সমর্থন। কথাটা হলো:- "আজ যেটা ম্যাজিক, আগামীকাল সেটাই হয়ে যাবে 'বিজ্ঞান' । আর, আজ যেটা 'বিজ্ঞান', গতকাল সেটাই ছিলো 'ম্যাজিক'।" সোজা কথায়, কারণটা জানলেই বিজ্ঞান, আর না জানলেই সেটা ম্যাজিক। খুব সহজ এই তত্ত্ব। কি? পণ্ডিত মশাই, কী বুঝলেন ? এটা মোটেই বাচ্চাদের ব্যাপার নয়। ####### ####### ##### একটা শিশু, তাকে আদর করে "একটা গান গাও তো " বললে ও নিজের মতো করে সুর করে গান গায়। তাকে হয়তো কেউ তখন আশা ভোঁসলে বলবেন না। কিন্তু অন্তস্থ সঙ্গীত প্রকাশ পেয়ে সে তার শিল্পী-সত্ত্বা প্রকাশে তাঁরা যে একই শিল্পের-প্রকাশ করছেন, তাতে সন্দেহ নেই। একটা শিশুকে যদি মিউজিকের সঙ্গে নাচতে উৎসাহ দিয়ে,। " নাচো, নাচো ! নাচো তো দেখি " বলা হয়, তাহলে সে পা ঝাঁকিয়ে, লাফিয়ে ওর নিজের মতো করে নাচতে শুরু করে। এটা নিশ্চয়ই আপনারা খেয়াল করেছেন। এটা হলো সহজাত শিল্প প্রকাশের প্রাথমিক স্তর। ঠিক ওই একই বয়সে ও যখন কোলে উঠে আমার চশমাটা খুলে নিয়ে পেছনে লুকিয়ে রেখে বলে, "নেই, নেই", তখন সেটা হয় তার অন্তস্থ জাদুশিল্পীর প্রাথমিক আত্মপ্রকাশ । চাতুর্য্য কলা, নাটকীয়তা এবং 'চোখের বাইরে'- এই বুদ্ধি জ্ঞানের সরল শিল্প-প্রকাশ। এটা জন্মগত, সহজাত আর্ট। হেজে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের এটা বোঝাতে হবে যে এটা চিরন্তন। এর ওপরেই পেঁয়াজের খোসার মতো বিজ্ঞান চেতনার স্তরের পর স্তর জমে ঘটে সার্বিক উন্নয়ন। ওটা হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রাণ কেন্দ্র বিন্দু। একে অবজ্ঞা করাটা চরম মূর্খামি। ম্যাজিক বাচ্চাদের জন্য নয়, সবার জন্য। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সের 'বাচ্চা'দের জন্য। দিনকে দিন মানুষ 'প্রগতি'র কারণে আরও নিজেকে সমস্যায় জড়াচ্ছে। নানা রকম সমস্যা। এখন মুক্তির খোঁজে , নিঃশ্বাস নেবার জন্য নিজেদের ছোটবেলাকে, ছেলে-মানুষীকে ফিরে পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দায়-দায়িত্ব বন্ধন ছিঁড়ে সত্যিকারের স্বাধীনতা পাবার সেই চেষ্টা । কিন্তু, মুক্তি পাওয়া তো দুষ্কর। কবিগুরু কেঁদে বলেছিলেন, " ওরে মুক্তি কি তোর আছে?" মনোরঞ্জনের আসরে নাকি সাময়িক মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানেও তো মড়ক লেগেছে। গল্পে না আছে যুক্তি, না আছে শান্তি, সেখানেও রাজনীতি, কুৎসা,ঝগড়া, ব্যাভিচার, মরাকান্না ইত্যাদিতে ভরা। ম্যাজিকে ওসব নেই। আর সেটাই হচ্ছে, আমি যদি কিছু সাফল্য পেয়ে থাকি, তো সেটাই তার অন্তর্নিহিত, গোপন রহস্য। ম্যজিকের আইডিয়া আমি পাই বাচ্চাদের কাছে থেকে। মনে আছে, ম্যনিলাতে যখন আমি প্রথম শো করি, তখন আমার বড় মেয়ে ' মানেকা'র বয়স তিন। দিনটা ছিলো, ওর জন্মদিনের দিন। সেজন্য সবাই মিলে গ্যাস- বেলুন দিয়ে হোটেলে একটা ঘর সাজানো হচ্ছিলো। রাতে পার্টি হবে। তখন ও আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা, গ্যাস বেলুন ওড়ে কেন, অন্য ফোলানো বেলুন তো ওপর দিকে উড়ে যায় না!!??

আমি তখন ওকে ওর মতো করেই বুঝিয়ে বলি, গ্যাসের হালকা হওয়ার তত্ত্বটা। আমি অনেকগুলো গ্যাস বলুন ধরে রেখে ছিলাম। পরে আরো কয়েকটা গ্যাস বেলুন নিতে গেলে ও চিৎকার করে ওঠে, বলে, “বাবা, তুমি আর বেলুন নিও না। তোমাকে টেনে উড়িয়ে নিয়ে যাবে!!”
ব্যাস্ ! আমি একটা নতুন আইডিয়া পেলাম।
“শূণ্যে ভাসমান বালিকা”, একটা পুরোন ম্যাজিক! সেটার উপস্থাপনায় এই গ্যাস-বেলুন জুড়লে কেমন হয় !! আর কেউই তো এটা এমন ভাবে দেখান নি ।
পরের বছরই আমি সেটা মঞ্চস্থ করি। আমি প্রথম।
একটা খালি চোঙা। তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে আমি একটা বেলুন আবির্ভাব করালাম। বড়ো গ্যাস বেলুন। সেটা একজন সহকারিণীকে ধরতে দিই। সে সূতোটা ধরে। তারপর আবার আর একটা বেলুন আবির্ভাব করিয়ে তাকে সূতো ধরতে দিই। সে ধরে। এভাবে একের পর এক বেলুন বের করে আমি তাকে দিচ্ছি তো দিচ্ছি, দিয়েই যাচ্ছি। ওদিকে মেয়েটার হাত যে টানটান উঁচু হয়ে মেয়েটাকে টেনে ভাসিয়ে নিয়ে ওপরে উড়ে চলে যাচ্ছে সেদিকে যেন আমার খেয়ালই নেই। দর্শকদের চিৎকারে আমার নজরে আসে । তখন আমি তাকে একটা একটা করে বেলুন ছেড়ে দিতে বলি। সে একটা করে বেলুন ছাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে সে একটু একটু করে নীচে নামে। শেষে সব কটা বেলুন ছেড়ে উড়িয়ে দিয়ে মঞ্চে নেমে স্বস্তি পায়। ম্যাজিকটা সুপার হিট হয়। আইডিয়া পেয়েছিলাম, আমার তিন বছরের কণ্যে 'মানেকার' কাছ থেকে। এভাবে আমি আমার আবিষ্কৃত সব ম্যাজিকেরই আইডিয়া পেয়েছি ঐ বাচ্চাদের কাছে থেকে। হাততালি দিয়েছেন 'বড়ো'রা।
নীচের ছবিটা ম্যানিলায় তোলা। বেলুনের টানে উড়ে যাবার আইডিয়াটা পাবার পর। মানেকার আশঙ্কা মতো আমি যেন উড়তে চলেছি সেই অভিনয় করে ওকে ধন্যবাদ জানাবার সময়।
শুধু আমার মানেকা নয়, পৃথিবী জুড়ে যতো মানেকা আছে, তারা সবাই-ই হলো জাদুসৃষ্টির কর্তা-কর্ত্রী।
ওরাই আমাকে মায়া-শিল্পী বানিয়েছে । ম্যাজিক নিছক সব বয়সের বাচ্চাদের জন্য নয় । ম্যাজিক জন্ম দিয়েছে সব বয়সের বয়স্ক শিশুদের, পৃথিবীর সবকটা পি সি সরকার ‘ জুনিয়র’ দের। ওদের কাছে আমি ঋণী।
Be First to Comment