ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। কলকাতা, ১, ডিসেম্বর, ২০২০। ঋক্ বেদে লেখা আছে:-
“अहमिद्धि पितुष्परि मेधामृतस्य जग्रभ”।।
মানে, “আমি যা শিখেছি, তা আমি আমার বাবার কাছে শিখেছি। “সত্যিই তাই। বাবা হাতে ধরে না দেখালেও, বাবার কাছেই আমি শিখেছি।
এরই নাম হচ্ছে, পরম্পরা। কবি গুরুর ভাষায় “…এমনি বহে ধারা…”। কি সুন্দর কাব্যময় কথা!
শুনতে ভালো লাগলেও আমার ক্ষেত্রে ধারাটা হচ্ছে কখনো খরস্রোতা, কখনো জল-প্রপাতময়, কখনো ফল্গু নদী হিসেবেই চলমান। সবসময়েই অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য অঙ্গীকার বদ্ধ। নীঃশব্দে, নীরবে, পরিচয় বিহীন ভাবে উপনদীর জল মূল নদীর সাথে মিশে তখন একাকার ভাবেই চলেছি। কেউ জানেন না আমি কে? আমার এগিয়ে চলার দিক আমার হাতে নয়। ‘বাপের জমিদারি’ কথাটা ছিল স্বপ্ন-বিলাস অথবা শত্রুর উপহাস। কম্প্রোমাইজ করবার জন্য আমিও আমার পরিচয়টা গোপন রাখতাম। আমি কেন দলের সঙ্গে এখানে কম দামী হোটেলে আছি, খাচ্ছি? তাতে মানুষের অনুসন্ধিৎসা-জাত ব্যাঙ্গাত্মক প্রশ্নমালা থেকে রেহাই পেতাম। সেটা “কণ্ঠে দিলে লাগে,খুলতে গেলে বাধে”।
বাবার সঙ্গে সফরে গেলে দেখা হতো শুধু স্টেজে। সারাটা দিন বিভিন্ন বই পড়তাম। লিখতাম। দলের ছেলেদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতাম। রং করতাম, কাঠের কাজে তদারকি করতাম। পাইপ বেয়ে উঠে পর্দা ঠিকঠাক করতাম। তখন ‘মালিক-পক্ষ’ হিসেবে তাদের অনেকের গায়ের জ্বালা তার আমার ওপর দিয়ে অনেকেই মেটাতো। আমি নিঃশব্দে নীরবে বয়ে চলতাম। ফলে দু -পক্ষেরই অন্তরবার্তা আমি জেনেছি। ওরা ঝাল মেটাতে আমাকে খাটাতো। ফলে সব কাজ আমি দক্ষতার সঙ্গে নির্বিবাদে শিখে ফেলতাম। বাবা অবাক হতেন। সেটাই আমার প্রাপ্তি। বাবা এসে ধমকাবার সুযোগ পেতেন না। হতেন আচ্ছা জব্দ। পরে শুনেছি খু–ব আনন্দ পেতেন। মাকে বাড়ি ফিরে উনি নাকি বলতেন, “আমি এখন নিশ্চিন্তে মারা যেতে পারি। “কথাটা ভাগ্যিস্ আগে শুনিনি।তাহলে মহানন্দে খারাপ হতে পারতাম। এখন খুব কষ্টে খারাপ হয়েছি। চারদিকের মানুষেরা কেন এত ‘চালাক এবং ভালো’ তার একটা যুক্তিপূর্ণ জবাব পেতাম।
ইন্দ্রজাল-সম্প্রদায়ে বাবার পরিচয়টা, খুব কঠোর এবং হয়তো বা বেশ ‘নৃশংস ভাবে’ আমার কাছে ‘পিতৃপরিচয়ে পরিচিত’ ছিল না। তাতে আমার হয়তো বেশ অভিমান ছিলো। কিন্তু এখন আমি নিজে তিন কণ্যের ‘বাবা’ হয়ে বুঝতে পারি, বাবা আমাদের ‘অলীক দূরত্বে রেখে’ কতো ভালোবাসা, স্বাধীনতা প্রকাশ করেছেন। পুত্রের উপস্থিতির নিশ্চিন্তি নিজে ভোগ করতে পারেন নি। কি খেতেন জানি না। কি খেতে মন চাইছে, তাও জানিনা। অরগানাইজারা হয়তো সব দাম মিটিয়ে দেন, কিন্তু কোন ওষুধ, কোন জামাটা বাক্স থেকে বের করে হাতের কাছে দিতে হবে, টুকি টাকি নানা রকম কাজে সাহায্য করার প্রয়োজন হয়, তাতে সাহায্য করতে পারিনি। এত লোক থেকেও তিনি ছিলেন একদম একা। বাইরের কাউকে দিয়ে এসব কাজ আন্তরিক কাজ করানো তো সম্ভব নয়।
এ কেমন পুত্রের উপস্থিতির সুখভোগ?! উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত। মা বাড়িতে সবকিছু সামলাচ্ছেন। এখানে এলে ওদিকে হাহাকার লাগবে। বাবা এবং মা আমাদের দুজনেই নিঃসঙ্গ একাকী। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের মনোরঞ্জন করছেন। বহু মানুষের অন্ন স-স্থানের ব্যবস্থা করছেন। দেশের সুনাম বাড়াচ্ছেন, কিন্তু কেউ তার খবর রাখেননা। মানুষ নাকি দেখে দেখে আর ঠেকে শেখে। এটাই হচ্ছে বাবার কাছ থেকে দেখে-ঠেকে আমার প্রথম ম্যাজিক-শিক্ষা। আত্মবিশ্বাসের এবং স্বনির্ভরতার ম্যজিক।
বাবার এক বিখ্যাত ম্যাজিক “ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়া”।

বাবার এক জাদু কমণ্ডুলুতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের জল রাখা ছিল। বাবা এক-একটা প্রদেশে নাম বলছেন, আর সেই প্রদেশের পোষাক পরা এক প্রতিনিধি গ্লাস হাতে হাজির হচ্ছেন। বাবা তার গ্লাসে জল ভর্তি করে দিচ্ছেন। জলই জীবন।”নানা মানুষের স্পর্শে গড়া তীর্থ নীর” হচ্ছে ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়া… অফুরন্ত…পবিত্র। ছবিতে
বাবাকে জল ভরতে দেখা যাচ্ছে। পেছনে মহারাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে আমি। অন্য ছবিতে মাধব চৌধুরী, যতীন চৌধুরী, বীরেন দে এবং দলের কিছু মহিলা সহশিল্পীদেরও দেখা যাচ্ছে। ছবিটা জাপানের তোন্দাবায়াসি শহরে তোলা। March 1964.,এর কথা।

Be First to Comment