ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। ৩১, ডিসেম্বর, ২০২০। লোকে বলে,”আপ রুচি খানা আউর পর রুচি পরনা”। নিজের রুচি মতো খাও, আর অন্যের রুচি মতো সাজো। আমার জীবনে এই দুটো উপদেশই ঝ্যামেলা পাকিয়েছে। আমি আর আমিতে নেই। আমি হয়ে গেছি সম্পূর্ণ নানারকম “তোমাদের’-ই লোক” । তোমরা যারা যেমনটা চাও, ঠিক তেমনটা। আর তার ওপরেও তো নির্ভর করেছে আমি কেমন ম্যাজিক দেখাই তার মূল্যায়ণ আর ভারতবর্ষ কেমন, তারও পরিমাপ আর পরিচয়। ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডের সাথে সঙ্গে হয়তো মোজা চুরির কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু ইন্দ্রজাল দিয়ে তাঁদের হৃদয় চুরির সঙ্গে বিশ্ববাসীর কল্পলোকের রূপকথাময় ভারতবর্ষের একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে। ভারতবর্ষ জাদুর দেশ, এই সত্যটা শুনেও বুঝিনা। যে দেশেই যাই না কেন, মানুষ ভালোবেসে তাঁর বাড়িতে যেতে ডাকবেনই। তারপর খাওয়াতেও চাইবেন। সেখানে তিনি তখন তাঁর সামর্থ আর সংস্কৃতি অনুযায়ী, মনের মতো সেরা খাবারটাই পরিবেশন করতে চাইবেন। যদি মনোরঞ্জনের ব্যাপারী হও, তাহলে তোমাকে সেটা মেনে নিতেই হবে; এবং একটু হলেও খেতে হবেই। যতোই গা গুলিয়ে উঠুক না কেন, তাঁর আতিথেয়তাকে অপমান করে, "ওয়াক থু"- তুমি করতে পারবে না। ওই হাসি মুখে প্রশংসা করাটার ওপরই নির্ভর করছে, তোমার পরিচয়। তোমার মধ্য দিয়েই ওরা তোমার দেশের মানুষদের রুচি, চরিত্র, শিক্ষার গভীরতা, ভালোবাসাটা খাঁটি কাঁঠাইলের নাকি গদের আঠা, নাকি সেলোটেপে সাঁটা, সবকিছু তাঁরা মেপে নেবেন। সুতরাং খুব সাবধানী হতে হবে তোমাকে। অবশ্য তুমি যদি এলেবেলে কেউ হও তো অন্য কথা। এভাবে আফ্রিকার মাসাইদের গ্রামের ঝলসানো অচেনা মাংস (কুকুর?) থেকে শুরু করে, মার্কিন দেশে খাওয়া, পেপের বিচির মতো দেখতে, হড়হড়ে, প্র-চ-ণ্ড আঁশটে, কিন্তু মহামূল্যবান আভিজাত্যপূর্ণ ক্যাভেয়ার মাছের কাঁচা ডিম, সেটা যদি তোমার গরম গরম টোস্টের উপরে প্রলেপ করে তোমার নিমন্ত্রণ-কর্ত্রী মাখিয়ে এগিয়ে দেন ; অথবা আরবের কাতার দেশে বাছুরের পেট চিরে নারি-ভূরী ফেলে দিয়ে তার ভেতর পোলাও, বাদাম, কিসমিস ঠেসে ঢুকিয়ে আবার সেলাই করে জুড়ে, চোখের গর্তে দুটো টম্যাটো ঢুকিয়ে, পুরোটা আভেনে রোস্ট করে ধূমায়িত ভাবে আদর করে তোমাকে আপ্যায়ন করেন, বা মঙ্গোলিয়ায় হাজার চিবোনোতেও বশে না আসা ঘোড়ার ছিবড়ে মাংস গলাদ্ধকরণ, বা, ফিলিপিন্সের 'লাপু-লাপু' জীবন্ত কাঁচা মাছ নড়াচড়ার মাঝেই আঙ্গুল দিয়ে চিপে ছিড়ে, বা ফরমোসায় চিনে পরিবারের সবার সঙ্গে জ্যান্ত বাঁদরের মাথা ফাটিয়ে, চামচ দিয়ে খুবলে কাঁচা ঘিলু খেয়ে, চোখ বন্ধ করে একবার অন্ততঃ " আঃ"- না বললে, তো তুমি কালচারাল অ্যামবাসাডর নও।

যা বললাম, সত্যি বললাম। ওদের মনজয় করতে আমাকে হাসিমুখে বহুবার খেতে হয়েছে। আমি একা নই। মানেকা, মৌবনি, মুমতাজ এবং আমার নির্জলা উপবাস-করা, বাড়ি জুড়ে ধানের ছরা আর মাঙ্গলিক পদচিহ্ন সমেত দুর্দান্ত আলপনা আঁকিয়ে, বসে দুলে দুলে পাঁচালী পড়া, নিজ হাতে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজো করা এবং আমাদের শাসিয়ে করজোরে বসিয়ে রাখা আদরের বৌ, জয়শ্রীও খেয়েছে। খেয়ে তুলসীপাতা চিবিয়ে ধর্ম রক্ষা করে আছে। সতীর পূন্যেই পতির পূন্য ঘটে গেছে। আমি
শিয়োর।

Be First to Comment