Press "Enter" to skip to content

প্রতিভা বসু’র প্রতিভার স্ফূরণ জন্মাবধি। ছোট থেকেই সুরেলাকণ্ঠী রানু (প্রতিভা’র ডাকনাম)। শৈশবেই ঢাকা শহরে সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ প্র তি ভা ব সু

বাবলু ভট্টাচার্য : এক বার গান শুনেই ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিতে পারে সেই গানের সুর, ভাষা। সে এমনই আশ্চর্য মেয়ে! আপন কন্যার এ হেন প্রতিভায় বিস্মিত হয়েছিলেন খোদ আশুতোষ এবং সরযূবালা সোম। পরে অবশ্য তাঁদের এই প্রতিভাময়ী কন্যার আরও নানা দিক উদ্ভাসিত হয়েছিল। সংসার সামলে হয়ে উঠেছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সাহিত্যিক। আর দেশপ্রেমিক সত্ত্বা তো তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিলই। এই কন্যার নাম প্রতিভা বসু।

প্রতিভা বসু’র প্রতিভার স্ফূরণ জন্মাবধি। ছোট থেকেই সুরেলাকণ্ঠী রানু (প্রতিভা’র ডাকনাম)। শৈশবেই ঢাকা শহরে সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।

বাবা আশুতোষ সোম মেয়েকে যারপরনাই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কথার কথা স্বাধীনতা নয়! রীতিমতো ডালপালা স্বাধীন ভাবে মেলে ধরবার স্বাধীনতা। তাই, সমকালের ঠুনকো সামাজিকতাকে পাত্তা না দিয়েই নামকরা উস্তাদদের (চারুদত্ত, মেহেদি হোসেন, ভোলানাথ মহারাজ, প্রফেসর গুল মহম্মদ খাঁ) কাছে গান শিখিয়েছিলেন মেয়েকে। এরই সুবাদে মাত্র ১১ বছর বয়সে রানুর প্রথম গানের রেকর্ড বের হয় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ থেকে।

সঙ্গীতের সূত্রেই দিলীপ কুমার রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখদের সান্নিধ্য লাভ এবং সঙ্গীতশিক্ষার সৌভাগ্যও অর্জন করেছিলেন প্রতিভাদেবী। তবে, তাঁর এই খ্যাতির শিরোপা সারা জীবনের সঙ্গী হয়নি।

‘ডাকাবুকো’ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে বিবাহের সূত্রে তার জীবন থেকে সঙ্গীত চিরতরে বিদায় নিয়েছিল। এ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু ‘আমাদের কবিতাভবন’-এ লিখেছেন, ‘….বিয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যে রানুর গানের চর্চা শুকিয়ে গেলো। সে তোড়জোড় বেঁধে শুরু করেছিলো কয়েকবার কিন্তু ধারাবাহিকভাবে চালাতে পারেনি। নিয়মিত ওস্তাদের বেতন জোগাতে গেলে বাজার খরচে টান পড়ে আমাদের, সাহিত্যিক অধ্যুষিত হাস্যরোলমুখর ছোট ফ্ল্যাটে খেয়ালের তান পাখা মেলতে পারেনা। উপরন্তু অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো আমাদের শিশুকন্যাটি; রানু হার্মোনিয়াম খুলে গানে টান দিলেই সে ভয় পেয়ে তার মায়ের মুখ চেপে ধরে, জীবনের প্রবলতর ধ্বনির কাছে সুরশিল্পকে পিছু হটতে হয়। হয়তো এও এক বাধা ছিলো যে আমি রাগসঙ্গীতে বধির এবং রানুর নিজেরও নেই সেই জেদ এবং উচ্চাশা, যার উশকানি বিনা প্রকৃতি-দত্ত ক্ষমতা একলা বেশিদূর এগোতে পারেনা।’

জীবনে এক পর্বের অবসান ঘটলেও অবশ্য শুরু হয়েছিল নতুন অধ্যায়ের; সৃজনশীলতা দানা বেঁধেছিল নতুনরূপে। যার আত্মপ্রকাশ সাহিত্য সৃষ্টির পথে। তবে, লেখিকার ‘লেখার কু-অভ্যাস’ আশৈশবের। তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলছবি’ পড়ে জানতে পারি। ছেলেবেলায় মায়ের কথামতো মন খারাপের কারণ দেখিয়ে চিঠি লেখা কিম্বা ‘নবশক্তি’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকায় ছোটগল্প লেখার প্রবণতা সেই প্রতিভারই অঙ্কুরোদ্গম স্বরূপ; যা পরবর্তীতে মহীরুহে পরিণত হয়।

প্রতিভা বসু সারাজীবন ধরে লিখেছেন প্রায় পঁয়তাল্লিশটির মতো উপন্যাস (‘মনোলীনা’, ‘সেতুবন্ধ’, ‘মনের ময়ূর’ প্রভৃতি), অসংখ্য ছোটগল্প (‘সুমিত্রার অপমৃত্যু’, ‘মাধবীর জন্য’, ‘ইষ্টিশানের মিষ্টি ফুল’ ইত্যাদি), ভ্রমণকাহিনি (‘স্মৃতি সততই সুখের’- ১’ম ও ২’য় খণ্ড), স্মৃতিকথা (‘ব্যক্তিত্ত্ব বহুবর্ণে’), গদ্যগ্রন্থ (‘মহাভারতের মহারণ্যে’), আত্মজীবনী (‘জীবনের জলছবি’) প্রভৃতি।

সৃজনশীল সাহিত্যসৃষ্টির জন্য তিনি পেয়েছেন লীলা পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জগত্তারিণী গোল্ড মেডেল। তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে বাংলা ও হিন্দিতে সিনেমাও হয়েছে।

প্রতিভা বসু’র জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। সঙ্গীত আর সাহিত্য ছাড়াও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন খুব অল্প বয়সে। সমকালের বিখ্যাত রাজনীতিক লীলা নাগের হাত ধরে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের ফাঁসি রদ করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল, কিন্নরকণ্ঠী রানু লীলাদি’র কথামতো গান গেয়ে সেই অর্থ জোগাড় করেন; ফাঁসিও রদ হয়।

লীলাদি’র ব্যক্তিত্ত্ব, আদর্শ, সাহসিকতা রানুকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, পরবর্তীতে তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণেও আমরা লীলাদি’কে খুঁজে পাই।

সাহিত্যিক প্রতিভা বসু’র জন্ম দেশের এক টালমাটাল সময়ে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখেছেন স্বাধীনতা আন্দোলন, পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে বিপ্লবীদের আত্মবলিদান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক হিংসা, স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও তার অভিশপ্ত পরিণতি– দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা।

প্রতিভার গল্প-উপন্যাসে এইসব বিষয়গুলি বারে বারে ফিরে এসেছে সহজ সরল বাচনভঙ্গিতে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন নারীর জীবনযন্ত্রণার আলোচনায়। পুরুষতন্ত্রের কঠিন নিয়মে, সামাজিক অনুশাসনের চাপে মেয়েরা কী ভাবে দিনের পর দিন শোষিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হচ্ছে, তার করুণ চিত্র।

অবশ্য তাঁর ব্যক্তিজীবনের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, পিতার আশ্রয়ে এতটাই স্বাধীনতা পেয়ে বড়ো হয়েছেন, যা হিংসে করার মতো ছিল। এমনকি, সেই স্বাধীনতার এক চিমটেও খামতি পড়েনি স্বামীর সঙ্গে ঘর বাঁধতে গিয়ে। আসলে ব্যক্তিজীবনে নয়, সামাজিক দিক থেকে নারীর যে দুর্দশাকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাকেই তিনি লেখনীর মধ্যে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর রচনায় ব্যতিক্রমী বৈভবেরও স্বাদ পাওয়া যায়।

আগেই বলেছি প্রতিভা বসু’র জীবন ছিল নানান বৈচিত্র্যে ভরা। তাই জীবনের অর্ধেক সময় সুখের জোয়ারে অতিবাহিত হলেও; একসময় স্বামীর মৃত্যু, পুত্রের মৃত্যু, পীড়াগ্রস্ত জীবের দংশনের বিষক্রিয়ায় চলৎশক্তিহীন ভাবে জীবনধারণে দুঃখই হয়েছে তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। তবুও তিনি মনোবল হারাননি। সুদৃঢ় মননশীলতাই তাঁকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছে। লিখে গিয়েছেন একের পর এক গল্প-উপন্যাস।

১৩ অক্টোবর ২০০৬ সালে বিশিষ্ট এই সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।

প্রতিভা বসু ১৯১৫ সালের আজকের দিনে (১৩ মার্চ) ঢাকার বিক্রমপুরের হাঁসাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

More from BooksMore posts in Books »
More from InternationalMore posts in International »
More from Writer/ LiteratureMore posts in Writer/ Literature »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.