সিঞ্চিনী পোদ্দার : ১৩, জুন ২০২১। নিজের স্ত্রীর সাথে বৌদ্ধিক বনিবনা না হওয়ায় তা নিয়ে অক্ষয়কুমার দত্তের সারাজীবন আক্ষেপ ছিল। তাই হয়তো ১৮৫১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্য বস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি দম্পতির সম্পর্ক নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছিলেন। “পরস্পর বিরুদ্ধ-স্বভাব, অসম-বুদ্ধি ও বিপরীত-মতাবলম্বী স্ত্রী-পুরুষের পাণিগ্রহণ হইলে উভয়কেই যাবজ্জীবন বিষম যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়। মানসিক ভাব ও বুদ্ধি চালনা বিষয়ে কিঞ্চিৎ বৈলক্ষণ থাকাতে কত কত দম্পতি মহা অসুখে কাল যাপন করিয়া থাকেন ; তাঁহারা আপনারাই আপনাদের অপ্রণয়ের কারণ বুঝিতে পারেন না।” তাঁর মতে বিবাহের আগে সাবালক ও সাবালিকার উচিত পরস্পরের সঙ্গে ভালোমত আলাপ পরিচয় করে নেওয়া। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রুচির মিল না থাকলে দাম্পত্যজীবন সুখের হয় না। “ফলতঃ বিদ্যাবান, উদার-স্বভাব, মহাশয় পুরুষের সহিত কোন বিদ্যাহীনা, কলহ-প্রিয়া, ক্ষুদ্রাশয়া রমণীর পাণিগ্রহণ হওয়া অশেষ ক্লেশের বিষয়।” এবং সেক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ নেওয়া কর্তব্য।
এর ছেচল্লিশ বছর পর ১৮৯৭ সালের নভেম্বর মাসে লাহোরে প্রদত্ত ‘বেদান্ত’ শীর্ষক বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ ঘোষণা করেন, “তবে ইহা বলিয়া রাখি যে, বাল্যবিবাহ-প্রথা যে-সকল ভাব হইতে উদ্ভূত হইয়াছে, সেই-সকল ভাব অবলম্বন করিয়াই প্রকৃত সভ্যতার সঞ্চার হইতে পারে, অন্য কিছুতেই নহে। যদি পুরুষ বা নারীকে অপর যে কোন নারী বা পুরুষকে পত্নী বা পতিরূপে গ্রহণ করিবার স্বাধীনতা দেওয়া যায়, যদি ব্যক্তিগত সুখ ও পাশবপ্রকৃতির পরিতৃপ্তি সমাজে অবাধে চলিতে থাকে, তাহার ফল নিশ্চয়ই অশুভ হইবে—দুষ্টপ্রকৃতি অসুরস্বভাব সন্তানসমূহের উৎপত্তি হইবে। একদিকে প্রত্যেক দেশে মানুষ এই-সকল পশু-প্রকৃতি সন্তান উৎপন্ন করিতেছে, অপরদিকে তাহাদিগকে বশে রাখিবার জন্য পুলিশ বাড়াইতেছে। এভাবে সামাজিক ব্যাধির প্রতিকারের চেষ্টায় বিশেষ ফল নাই, বরং কিভাবে সমাজ হইতে এই-সকল দোষ, এই-সকল পশুপ্রকৃতি সন্তানের উৎপত্তি নিবারিত হইতে পারে, তাহাই সমস্যা। আর যতদিন তুমি সমাজে বাস করিতেছ, ততদিন তোমার বিবাহের ফল নিশ্চয়ই আমাকে এবং আর সকলকেই ভোগ করিতে হয়, সুতরাং তোমার কিরূপ বিবাহ করা উচিত, কিরূপ উচিত নয়, এ-বিষয়ে তোমাকে আদেশ করিবার অধিকার সমাজের আছে।”
উভয়ের চিন্তাধারার পার্থক্যটি দিনের আলোর মতো পরিস্কার। আজ থেকে ১৭০ বছর আগে অক্ষয় কুমারের এ-জাতীয় চিন্তাধারা যে কতটা বৈপ্লবিক ছিল তা নিয়ে বোধহয় আলোচনার প্রয়োজন নেই। সমকালীন বিদ্যাসাগর এবং আরও দশ বছর পরে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সারা জীবন ধরে তা অনুভব করে গিয়েছিলেন। কোনো এক সময় নারীর উপর নির্যাতন করা নারীকে অবহেলা করা নারীধর্ষন সহ নারীদের অসন্মানের প্রবনতা এতোটাই বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে বাধ্য হয়ে নারীসুরক্ষার জন্য একটা আইন প্রনয়ন করে ছিলো, নারী নির্যাতন আইন, যেটা বর্তমানে বধূনির্যাতন আইন বলা চলে, কিন্তু বর্তমানে নারীরা সেই আইনকে অপব্যবহার করে পুরুষের উপর খবরদারি করছে পুরুষধ্বংসে লিপ্ত হয়েছে, উল্টো পুরুষের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, আর তাতে সহযোগিতা করছে নারীবাদের আর নারী ভোগি লোভী পুরুষ, তাই এই আইন পরিবর্তন করতে হলে আন্দোলন ব্যতীত কোনো পথ নেই। রুদ্রা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন একটি নিশুল্ক ফাউন্ডেশন, যারা ২০১৪ থেকে প্রচুর সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত, পীড়িত পুরুষ-নারী নির্বিসারে আইনি সাহায্য তথা মানসিক শক্তি দৃঢ় করতে সাহায্য করে। কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় রুদ্রার বিভিন্ন শাখা বিস্তারিত হয়েছে। তার মধ্যে হুগলি, ভবানিপুর ও বেহালা অন্যতম। রুদ্রার লিগাল সেল খুবই শক্তিশালী। কলকাতা হাইকোর্টের বিশিস্ট আইনজীবিরা রুদ্রার লিগাল সেলের যুক্ত। বর্তমানে বিভিন্ন RTI, জনস্বার্থ মামলার মাধ্যেমে রুদ্রার লিগাল সেল এগিয়ে চলেছে। বেশ কিছু মহিলা সদস্য বর্তমানে লিঙ্গ নিরপেক্ষ আইনের দাবীতে রুদ্রার হয়ে পথে নেমেছেন।
১৯৮৩ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮এ আইন প্রণিত হয় দেশে পণপ্রথা বিলোপ এবং বধূনির্যাতন রোধের উদ্দেশ্যে। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই অভিযোগ, এই আইনের অপব্যবহার হয়েছে। দাম্পত্যে উত্পীড়িত পুরুষরা এইসব আইনকে ‘জেন্ডারবায়াস’-এ দূষিত বলে অনেক দিন আন্দোলন করছে। তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ৪৯৮(এ) ধারার অধীনে বছরে প্রায় ১৮,১১৬টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। সারা দেশের মধ্যে যা সর্বাধিক। সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গেই। অথচ এ রাজ্যে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ২.৩%। এই মামলার সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গই প্রথম। পশ্চিমবঙ্গে এই মামলার সংখ্যা প্রায় ১৮,১১৬টি। এরপরই রয়েছে রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশের স্থান। এদেশে যতগুলি বধূনির্যাতনের মামলা হয়, তার প্রায় চোদ্দোআনার ক্ষেত্রেই অভিযোগ কিচ্ছুটি প্রমাণ করা যায় না। বেশির ভাগটাই ভুয়ো! স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অপদস্থ করার কৌশল মাত্র। যার সুযোগ মহিলাদের পেতে প্রশাসন তথা অসৎ উকিলবাবুরা যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন। আর এর ফলে কত নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কয়জন এর খবর রাখে? ভারত সরকারী সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের ৮৬% বধূ নির্যাতন মামলা মিথ্যা, ৭৩% ধর্ষন মামলা মিথ্যা, ৭৪% শ্লীলতাহানির মামলা মিথ্যা। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অধিকাংশ অভিযোগ মিথ্যা। প্রতি বছর ভারতে বিবাহিত পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বিবাহিত মহিলাদের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশী।
অসৎ উকিল বাবুরা মহিলাদের আইনের অপব্যবহার করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আদালতে ও মহিলা কমিশনে শাশুড়ি, ননদ, জা চরমভাবে উপেক্ষিত অর্থাৎ বর্তমানের আইনকে স্বামী তথা শ্বশুর বাড়ির লোকেদের বিরুদ্ধে অপব্যাবহার করে মিথ্যা অভিযোগকারিণীকে সামান্য লভ্যাংশ দিয়ে বেশিটাই অসৎ উকিল বাবুরা দখল করতে পারেন; অর্থাৎ সম্পত্তি ও অর্থ। কিন্তু প্রশাসন! প্রশাসন কেন মিথ্যা অভিযোগকারিণী ও তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গদের সাহায্য করছে সেটা বোধগম্য নয়। পশ্চিমবঙ্গে নারীকে সমমর্যাদা এমনকি অনেকাংশে অধিকমর্যাদাই দেওয়া হয়। সেই নারীরা আজ নিজের প্রাপ্ত সম্মানকে অপব্যাবহার করে অর্থ পিশাচিনির ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। পণপ্রথা নিরোধক আইন, ১৯৬১ র ৩ ধারা মোতাবেক পণ দেওয়া ও নেওয়া দুটোই সমান অপরাধ কিন্তু বিগত প্রায় ৫০ বছরে কোনো বধূ পক্ষের শাস্তি হয় নি। আমরা দেখেছি বারাসতের হৃদয়নগরের বাসিন্দা অনুপম কীভাবে তার স্ত্রী মনুয়া মজুমদারের প্রতক্ষ ষড়যন্ত্রে নৃশংস ভাবে খুন হয়েছিলেন। রাজারহাটের বিশিস্ট আইনজীবি রজত বাবুর গলায় মোবাইলের হেডফোন পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করেছিলো তার স্ত্রী অনিন্দিতা। এরকম মনুয়া, অনিন্দিতা গোটা রাজ্যে শ-য়ে শ-য়ে ছড়িয়ে রয়েছে। অথচ স্বামীকে খুন করার পরেও মনুয়া বা অনিন্দিতা কেউই সর্বোচ্চ সাজা পায়নি। উভয়ের বিচারেই যাবত জীবণ কারাদন্ড হয়। দায়রা আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির দ্বারা ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত (১৪.০৮.২০১৪) ৫ পৈশাচিক মহিলা অপরাধীর (সীমা গাভিট, রেনুকা সিন্ডে, শবনম, সোনিয়া, কেডি মাপ্পা ) ফাঁসি কার্যকর কবে হবে ?? অথচ আইনের চোখে সবাই সমান, অপরাধীর কোন জাত-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ হয়না। যাবজ্জীবণ সাজাপ্রাপ্ত মনুয়া মজুমদার কে আজ রেডিও জকি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এইভাবেই কী মৃত অনুপম বাবুর প্রতি আমরা ন্যায়বিচার প্রদান করছি। রুদ্রার লিগাল সেল এর বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রী কৌশিক ভট্টাচার্য এর মতে “সংসার পুরুষ মানুষকেই যে কোরে হোক চালাতে হয়। বধূর চাকরি করার সময় নারী স্বাধীনতা কিন্তু সংসার চালানোর সময় স্বামী তুমি ভাতার কাজেই সংসার চালানোর সব দায়িত্ব তোমার, আমার টাকাটা শুধু ফুর্তি আর ব্যাঙ্কে জমানোর জন্য। প্রতিবাদ করলেই তীব্র অশান্তি তারপর মিথ্যা বধূ নির্যাতন মামলায় জেল। সঙ্গে বধূর চরম পরকীয়া। ভারতের আইনে পুরুষকে সবসময় অপরাধী ধরে নেওয়া হয়। সুতরাং তার কোনো অভিযোগ আনার জায়গাই আইনে নেই।“
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ও ৩৭৬ ধারাকে পুরুষদের প্রতি বৈষম্যমূলক বলে দাবি করে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন এক ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, বর্তমান আইনে শুধু পুরুষদেরই ধর্ষক এবং মহিলাদের ধর্ষণের শিকার বলে ধরা হয়। কিন্তু সংবিধানের ২১নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাই আইনের চোখে পুরুষ ও নারী সমান হওয়া উচিত।
আপনারা কি জানেন ২০১৩ সালে লিঙ্গনিরপেক্ষ ধর্ষণ আইন চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রতিবাদের জেরে মাত্র ৫৮দিন পরেই এই আইন বাতিল করা হয়। ভয়তো তারাই পাবে-যারা পাপী, অপরাধী ও প্রতারক। লজ্জাতো তাদের হওয়া উচিত যারা সারা জীবন নিজেদের দূর্বল সাজিয়ে অন্যের সহানুভুতি নিয়ে প্রতারণা করছে এবং রাষ্ট্রের আইনকে অপব্যবহার করছে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও নির্দল সাংসদ কে টি এস তুলসী যিনি ইতিমধ্যেই জুলাই, ২০১৯ এ লিঙ্গ নিরপেক্ষ ধর্ষন ও শ্লীলতাহানি আইনের জন্য বেসরকারী বিল রাজ্যসভায় পেশ করেছেন কিন্তু সরকারী অনীহায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছে না আজ অবধি। শুধুমাত্র স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অপরাধ হিসাবে নয়। ক্রমবিকাশের সাথে পা মিলিয়ে পুরুষদের প্রতি পারিবারিক হিংসাকে দমন করবার একটি নীতি অত্যন্ত আব্যশ্যক বলে মনে করে পুরুষাধিকার নিয়ে কর্মরত ভারতীয় একটি সংগঠন, সেভ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন (এস.আই.এফ.এফ),। রুদ্রার প্রেসিডেন্ট শ্রী পার্থ সারথি চক্রবর্তী বলেন “পুরুষাধিকার আন্দোলন মানে আদৌ নারী বিদ্বেষ নয়, শুধুই ত্যদর নারী / বধূর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। আইনে যাদের শাস্তির উল্লেখ নেই। এর পাশাপাশি সমাজে লিঙ্গ নিরপেক্ষ আইনের দাবীতে গর্জে ওঠা। যেখানে সবার সমান অধিকার। যারা বিয়ে করে নি, তারা যদি ভাবেন যে আমার কোনো নারী ঘটিত মিথ্যা মামলা খাবার ভয় নেই, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। ভারতের বর্তমান আইনী কাঠামোয়, যে কোনো ব্যক্তি যে কোন সময় মিথ্যা ধর্ষন বা শ্লীলতাহানির মামলায় ফেঁসে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দেশের আইন, আদালত, সরকার, সংবাদমাধ্যম কেউ তার পাশে দাঁড়ায় না। এটা সবাই মনে রাখুন। লিঙ্গ নিরপেক্ষ আইনের দাবীতে গর্জে উঠুন সবাই।” এই ভাবেই রুদ্রার লড়াই আগামীদিনেও অব্যাহত থাকবে।
Be First to Comment