পুজো নস্টালজিয়া (একাদশী ২) –
শান্তনু বসু : সংগীতশিল্পী ও বিশিষ্ট সুরকার, ২৮, অক্টোবর, ২০২০। জন্ম আমার কলকাতায়। বাবার চাকরি সূত্রে কিছুদিন বারাসত আর তারপরে মধ্যমগ্রাম। এরপরে চলে গেলাম জয়নগর মজিলপুরে। ছেলেবেলায় মফস্বলের খোলা আকাশের নীচে মাঠে, পুকুরে, বাগানে, মন্দির প্রাঙ্গণে আর ক্লাবে ক্লাবে আমার বেড়ে ওঠা। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে যখন কলকাতায় এলাম তখন বুক ভরা সঙ্গীতের নেশা। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের রীতিতে মস্তিষ্কে পড়াশোনার ব্যামো। পড়াশোনা চালানোর মাঝেই সঙ্গীতের অজানা জগতে প্রবেশ। অনুপ্রবেশ বললেই ভালো। সমগ্র সঙ্গীত জগৎ তখন আমার অপরিচিত। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলতে গেলে বলতে হয়- ” আনিলাম অপরিচিতের নাম সঙ্গীতজগতে।” ক্রমশ একটু একটু করে জানা, বোঝা, শেখা থেকে ধীরে ধীরে পরিচিতি। পথচলা শুরু হলো। একে একে গুণীজনদের স্নেহ সান্নিধ্য পেতে শুরু করলাম। চতুর্দিক থেকে ডাকও আসতে থাকলো। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে কলকাতার সব স্টুডিও তখন আমার গন্তব্য। জীবনের প্রথম সিনেমার গানের রেকর্ডিং-এর দুজন আর্টিস্ট-এর নাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আরতি মুখোপাধ্যায়। তারপরে একে একে সবার সঙ্গেই কাজ হলো। তবে যত সহজে লিখলাম তত সহজে যে সবটা হয় নি – সেটা বলাই বাহুল্য। প্রতিদিনের recording ছিল পরীক্ষার মতো। তখন Technicians বা India Lab studio তে multi track recording system আসে নি। সমস্ত senior musicians দের মাঝে বাজানোকালে একবার অনিচ্ছাকৃত ভুল মানেই আবার প্রথম থেকে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রথিতযশা শিল্পীর বিরক্তি প্রকাশ আর পাশ থেকে কোনও কোনও musician-দের তীর্যক মন্তব্য। আর সেই Arranger বা Music Director এর ঘর থেকে চিরকালের জন্য বাদ পড়ার আশঙ্কা। সব মিলিয়ে গ্রামে বড় হওয়া আমার কাছে এক মস্ত challenge। আবেগের কোনও স্থান নেই। চরম পেশাদারিত্ব। অসহনীয় গরমে technicians এ কত recording যে গরমের ঠেলায় জামা খুলে করতে হয়েছে তা আর মনে নেই। টেক-টা শেষ হলেই সবাই গাছ তলায় গিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতাম।
যে HMV company musician list থেকে অপরিচিত বলে আমার নাম এক সময় বাদ দিয়েছিল সেখানে পরবর্তী সময়ে কত কাজ যে করেছি এমন কি Music Arrangement-ও – তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সবই জীবনে চলার সঙ্গী। পরে আমাকে দিয়ে Piano album-ও ওরা করিয়েছেন। সেই HMV র একটা কাজের গল্প এবার বলবো। ৯০এর দশক। ঝিমিয়ে পড়া বাংলা গানের পালে দমকা হাওয়া দিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। ‘তোমাকে চাই’ এর পরে সুমনের Cassette মানেই Hot cake। গান ভক্ত এক বিরাট শ্রেণীর নয়নের মণি তখন কবীর ‘সুমন’। লেখা, সুর, গাওয়ার সঙ্গে Arrangement, Programming সব কিছু নিজে করতেন। Guitar, Mouth organ সব একা। এত বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় বাংলা গানের জগতে আর এসেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। তার সঙ্গে অগাধ পড়াশোনা। বাচন ক্ষমতা। আর ওই মন পাগল করা কন্ঠস্বর। আহা! হঠাৎ সুমনদা ভাবলেন অন্য কেউ ওঁর গান arrangement করবেন। সেই সময় সঙ্গীত আয়োজক অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় মারফত আমি ডাক পেলাম। তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সুমনদার সঙ্গে পরপর দুটো বা তিনটে অ্যালবামে তখন আমরা কাজ করেছিলাম। এই কদিনের সঙ্গীতজীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। হারিয়েছিও অনেক কিছু। কিন্তু পরম প্রাপ্তির মধ্যে অন্যতম সুমনের গানের কথায় ‘আমার নাম’। বাংলাদেশের সঙ্গীত ইতিহাসে মিউজিশিয়ানদের এত বড় সম্মান কেউ দেন নি। কেউ না। ক্ষমতাও নেই। ভাবনা তো নেইই। কত গীতিকার, সঙ্গীতকার আর সহশিল্পী দরদী গায়ক-গায়িকা তো দেখলাম! মিউজিশিয়ানদের ব্যাপারে সবাই, হ্যাঁ সবাই – উদাসীন। আজ কবীর সুমনের ব্যাঁকাট্যারা কথা নিয়ে যাঁরা টিপ্পনি কাটেন তাঁদের বলি – কবীর সুমন সম্বন্ধে বলতে পারেন একমাত্র আর একজন কবীর সুমনই। আর কেউ নয়। যদিও এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। এই মুহূর্তে miss করছি বন্ধু সঞ্জয় চক্রবর্তী আর বাপিদা, মানে তবলিয়া বাপি দেবকে। ওঁরা আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। সুমনদাকে প্রণাম। আপনার পাণ্ডিত্যের প্রতি নতমস্তকে জানাই সেলাম।
NB – মন দিয়ে গানটা শুনতে হবে।

Be First to Comment