স্মরণঃ পণ্ডিত ভীমসেন জোশী
বাবলু ভট্টাচার্য : পণ্ডিতজি যখন গান করেন, তখন মনে হয় সুরটাকে ঘেঁটি ধরে ওপর থেকে নামিয়ে আনছেন, অথবা কোনও সুরকে এমন বকাবকি করছেন যে ওঁর গলায় সে বাধ্য ছেলের মতো যাওয়া-আসা করছে। ওঁর স্বরের যে বৈশিষ্ট্য, যাকে ‘টিম্বার’ বলা হয়, সেটা অসামান্য ছিল। আর যে এনার্জি নিয়ে উনি গান গাইতেন— সেটা খুব আকর্ষনীয়।
ভীমসেন জোশী ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণাটকের ধারওয়ার জেলার গডগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
ভীমসেন জোশী আদতে পুণের লোক। ওঁর ছোটবেলা খুব সুখকর নয়। বাড়িতে ছিলেন সৎমা। ব্যাবহার ভালো করতেন না। স্কুল যাওয়া-আসার পথে একটা রেকর্ডের দোকানে করিম খানের গান বাজত, আর ছোট্ট ভীমসেন মুগ্ধ হয়ে সেই গান শুনতেন, শুনে শুনে নিজে গাওয়ার চেষ্টাও করতেন। বয়স তখন এগারো। এক দিন, রুটিতে ঘি কম মাখিয়েছে মা, এই নিয়ে রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। আসলে ঠিক তা নয়। সৎভাইয়ের রুটিতে ঘি বেশি মাখিয়েছে মা, এ জন্য তিনি বাড়ি ছেড়ে পালাননি। তিনি আসলে উছিলা খুঁজছিলেন কিভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে গান শিখবেন।
তখনই উনি শুনেছিলেন গোয়ালিয়রে নাকি খুব ভাল ক্লাসিকাল মিউজিকের চর্চা হয়। আর হাফিজ আলি খান সাহেব, মানে আমজাদ আলি খানের বাবা, খুব বড় সঙ্গীতজ্ঞ। বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে পড়লেন। গন্তব্য গোয়ালিয়র। কিন্তু টিকিট চেকার তাঁর তাগিদের মর্ম কী বুঝবে? জরিমানার পয়সা তো নেই। অতএব ট্রেন থেকে নামিয়ে শ্রীঘরে পাঠিয়ে দিল। এই ভাবে কোথাও ক’দিন জেলে কাটিয়ে, কোথাও রাস্তায় শুয়ে থেকে, ফের বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে, ফের চেকারের গলাধাক্কা খেয়ে, তিন মাস পর পৌঁছলেন গোয়ালিয়রে।
হাফিজ আলি খানকে গান শুনিয়েছিলেন। চমকে গিয়েছিলেন খান সাহেব। এত কমবয়সি একটা ছেলের গলায় ধ্রুপদ গানের এমন সম্ভাবনা! উনি ভর্তি করে দিলেন গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া স্কুলে। খান সাহেবও পাকা জহুরি ছিলেন, তা না হলে, এত কম বয়সে নিজে উনি দরবারি শেখাতেন না ভীমসেন জোশীকে।
এই তালিমে কেটে গেল দুটো বছর। এখানেই পণ্ডিতজি শুনেছিলেন, কলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় বলে এক জন গুরু আছেন, যিনি ভগবান। পালিয়ে এলেন কলকাতায়। কিন্তু শিখবেন কী করে? সে খবরও জোগাড় হল। অভিনেতা পাহাড়ী সান্যালকে গান শেখাতে আসতেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। ভীমসেন জোশী কাজ নিয়ে নিলেন পাহাড়ী সান্যাল মশায়ের বাড়িতে। রান্না করতেন, টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার পৌঁছে দিতেন সিনেমার সেটে, আর চুরি করে গান শিখতেন।
ভীমসেন জোশীর পিতা গুরুরাজ সেই আমলে একজন এম এ পাস করা মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে যাঁর কয়েকটি বইও আছে। তাঁর পিতামহ ভীমাচার্য ছিলেন প্রসিদ্ধ কীর্তনকার। সব মিলিয়ে তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সঙ্গীত শিক্ষার অনুকূলে।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভীমসেন জোশী প্রথম মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং ২২ বছর বয়সে তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ভীমসেন জোশী খেয়ালের প্রচলিত ধারায় এনেছেন নতুনত্ব। এক অদ্ভুত নাটকিয়তা দিয়ে শুরু হয় তাঁর গান যা শ্রোতার মনকে আবিষ্ট করে রাখে। তাঁর কন্ঠে পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘরানার সংমিশ্রণে সৃষ্ট নতুন এক সুর।
কিরানা ঘরানার বিলম্বিত আলাপ যেমন রয়েছে তাঁর কন্ঠে তেমনি রয়েছে আগ্রার লয়কারি। তানের মধ্যেও তিনি এনেছেন নানা বৈচিত্র্য।
পণ্ডিতজী পদ্মশ্রী, সেরা কণ্ঠের জন্য ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, প্রথম প্ল্যাটিনাম ডিস্ক, পদ্মবিভূষণ, কর্নাটকরত্ন, ভারতরত্নসহ বহু সম্মান পেয়েছেন জীবনে।
পণ্ডিত ভীমসেন জোশী ২০১১ সালের আজকের দিনে (২৪ জানুয়ারি) মহারাষ্ট্রের পুনে-তে মৃত্যুবরণ করেন।

Be First to Comment