জন্মদিনে স্মরণঃ নীরদচন্দ্র চৌধুরী
বাবলু ভট্টাচার্য : অক্সফোর্ড নগরীর ২০ ল্যাদবেরি রোডের তিনতলা বাড়ির গেটে ইংরেজরা সেটির প্রাক্তন বাসিন্দার সম্মানে একটা নীল প্লাক বসিয়েছে।
বলা হয়েছে সেই মান্যজন— এক লেখক— সেখানে বাস করেছেন ১৯৮২ থেকে ১৯৯৯ অবধি।
লেখকের নামও অবশ্যই আছে, এবং জন্ম ও মৃত্যুর সন— ১৮৯৭-১৯৯৯।
সেই লেখক তাঁর প্রথম বই, ইংরেজি আত্মজীবনীর নাম যতই রেখে থাকুন ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’, তাঁকে এখন অচেনা, অজানা বলে চালানো বেশ কঠিন।
দেশি ও বিদেশি মহলে জব্বর নাম করার জন্য যা করার তা ওই প্রথম বইতেই করে রেখেছিলেন ভদ্রলোক, কিন্তু সেখানেই তিনি থামেননি। তার পর আরও অর্ধশতক ধরে লিখে লিখে সাহেব-মেম এবং স্বদেশের পড়ুয়াদের অকাতরে তাতালেন এবং মাত করে গেলেন।
ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের সেই নীরদচন্দ্র চৌধুরীকে তাঁর ইংরেজি লেখার দাপটের জন্য সবাই উল্লেখ করেন নীরদ সি চৌধুরী বলেই হামেশা। প্রায়শ কেবল নীরদ সি বলেই।
শৈশব, কৈশোর এবং প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষাকাল কেটেছে তার কিশোরগঞ্জ শহরেই ১৯১০ সাল পর্যন্ত। এরপর পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে কলকাতা গমন করেন। ১৯১৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করে রিপন কলেজে ভর্তি হন। তারপর স্কটিস চার্চ কলেজ থেকে ১৯১৮ সালে ইতিহাসে বিএ পরীক্ষায় অনার্স লাভ করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৯২২ সালে চাকুরী জীবন শুরু হয় বেসামরিক হিসাব রক্ষক হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাব রক্ষণ বিভাগে। পাশাপাশি লিখতেনও পত্র-পত্রিকায়। একসময় চাকুরী ছেড়ে সম্পাদনা ও সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। সেকালের জনপ্রিয় বাংলা ম্যাগাজিন ‘প্রবাসী’ ও ‘শনিবারের চিঠি’ এবং ইংরেজি ‘মর্ডান রিভিউ’ সম্পাদনা করতেন। এছাড়াও ‘সমসাময়িক’ ও ‘নতুন পত্রিকা’ শীর্ষক দুটি স্বল্পায়ুর বাংলা ম্যাগাজিনও বের করেন। তখন মেসে থাকতেন কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে মির্জাপুর স্ট্রিটে। সঙ্গী ছিলেন ছাত্রজীবনের সহপাঠি, ‘পথের পাঁচালী’র স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার।
১৯৩৭ সালে বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা ব্যারিষ্টার শরৎচন্দ্র বসুর একান্ত সচিব নিযুক্ত হন। সেই সুবাদে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সহ তৎকালীন বহু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সংস্পর্শে আসেন।
১৯৪১ সালে সচিবের চাকুরী ছেড়ে তিনি ‘আকাশ বানী’র কলকাতা শাখার রাজনৈতিক ভাষ্যকারের কাজে নিয়োজিত হন। পরে ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র কাজ নিয়েই সপরিবারে কলকাতা ছেড়ে দিল্লীতে চলে যান।
স্বাধীন ভারতে লেখালেখির কারণে তিনি সরকারী চাকুরীচ্যুত হন। ১৯৭০ সালে সপরিবারে ভারত ছেড়ে বৃটেনের অক্সফোর্ডে থিতু হন। ১৯৭২ সালে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে টেক্সাস ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন। তবে লেখালেখিই ছিল তার পরবর্তী জীবনের প্রধান জীবিকা।
নীরদ চৌধুরী বাংলায় যেসব বই রচনা করেছেন— বাঙালি জীবনে রমনী, আত্মঘাতি বাঙালি, আত্মঘাতি রবীন্দ্রনাথ, আমার দেবোত্তর সম্পত্তি, নির্বাচিত প্রবন্ধ, আজি হতে শতবর্ষ আগে।
ইংরেজিতে লিখেছেন— দ্য ইনটেলেকচুয়াল ইন ইন্ডিয়া, টু লিভ অর নট টু লিভ, স্কলার এক্সট্রাঅর্ডিনারি, দ্য লাইফ অব প্রসেথর, দ্য রাইট অনারেবল ফ্রেডরিক ম্যাক্স ম্যুলার পিসি, ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া, কালচার ইন দ্য ভ্যানিটি ব্যাগ, হিন্দুইজমঃ এ রিলিজয়ন টু লিভ বাই এবং পূর্ব প্রকাশিত রচনাসংকলন- দ্য ইস্ট ইজ ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট, ফ্রম দ্য আরকাইভস অব এ সেন্টেনারিয়ান ও হোয়াই আই মোরন ফর ইংল্যান্ড।
ইংরেজি সাহিত্যে ভারতীয় হিসেবে একজন অন্যতম সফল লেখকের খ্যাতি অর্জন করেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। তিনি বাংলা ইংরেজি ছাড়াও সংস্কৃত, হিন্দী, গ্রীক, ল্যাটিন, ফরাসী ও জার্মান ভাষায় প্রাজ্ঞ ছিলেন। বাংলা সাধু ভাষায় লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
লেখালেখির জন্য তিনি একসময় ভারত ও বাংলাদেশে বিরূপ সমালোচিত ও নিন্দিত ছিলেন। তার লেখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। পাশাপাশি তিনি অনেক মর্যাদাকর পুরস্কার এবং সম্মান অর্জন করেন— ‘দ্য কন্টিনেন্ট অব সারসি’র জন্য ১৯৬৬ সনে ‘ডাফ কুপার স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৯২ সনে রয়্যাল লিটারারি সোসাইটির ফেলোসিপ, (যুক্তরাজ্যের রানী এলিজাবেথ-২ স্বয়ং তাকে রাজকীয় সম্মান, কমান্ডার অব অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই) পদবী প্রদান করে সম্মানিত করেন) উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়াও আমাদের দেশে আনন্দ পুরস্কার, রাজ্য সরকার সরকার প্রদত্ত বিদ্যাসাগর পুরস্কার এবং ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ১৯৯০ সনে ডি.লিট. উপাধিতে ভূষিত করে। একই উপাধি স্টার্লিং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃকও দেওয়া হয়।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৮৯৭ সালের আজকের দিনে (২৩ নভে) বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কাটিয়াদিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment