স্মরণঃ জ্যা ক ল ন্ড ন
বাবলু ভট্টাচার্য : ১৮৭৫ সালের জুন মাসে ফ্লোরা উইলম্যান নামের এক তরুণী আত্নহত্যার চেষ্টা করেন, কারণ তার প্রেমিক জনৈক আইরিশ প্রফেসর গর্ভস্থ সন্তানটিকে পৃথিবীতে আনতে রাজী হচ্ছিলেন না। ফলে তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় চিরদিনের মতো। ভূমিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখা হয় জন গ্রিফিথ চ্যানি। কিছু দিনের মধ্যেই ফ্লোরার সাথে জন লন্ডন নামের এক ভদ্রলোকের পরিণয় ঘটে, শিশুটি আজীবন তার সৎ বাবার নাম গ্রহণ ও বহন করেই জগদ্বিখ্যাত হয়ে ওঠে— জ্যাক লন্ডন।
জ্যাক লন্ডন ১৮৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
শুরু হয় ধরণীর বুকে এক মূর্তিমান বিদ্রোহীর পথ চলা, দারিদ্রপীড়িত শৈশবে মাত্র ১২ বছর বয়সেই প্রতিদিন ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টায় কঠোর কায়িক পরিশ্রমের কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন ভবিষ্যৎ লেখক পেটের তাগিদে।
এর কয়েক বছর পরেই নিজের জমানো আর ধার করা টাকায় র্যাজেল-ড্যাজেল নামের এক পুরনো জাহাজ কিনে পুরোদস্তুর ঝিনুকদস্যু বনে যান জ্যাক। উপকূলীয় অঞ্চলে বেআইনি ভাবে ঝিনুক শিকার চলতে থাকে তার। এর ক’মাস পরেই সলিল সমাধি ঘটে তার সাধের জাহাজের। বাধ্য হয়ে মৎস্যজীবীদের দলে যোগদান করেন জ্যাক। পরের কয়েক বছর বলা চলে হেন কাজ নাই যা তিনি করেন নি বেঁচে থাকার তাগিদে।
এর পরপরই যোগ দেন স্বর্ণ অনুসন্ধানীদের দলে— অবারিত প্রকৃতির মাঝে কুকুরটানা স্লেজ গাড়ী নিয়ে চির তুষারের রাজ্যে— যে কঠিন জীবন ঘষে পাওয়া অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে গেছে পরবর্তীতে তার মহান উপন্যাস এবং ছোট গল্পগুলোতে।
আলাস্কার সেই বুনো নিসর্গের মাঝে মূল্যবান হলুদাভ ধাতু খোঁজার সময়ও জ্যাক পাগলপারা হয়ে পড়ে চলতেন ৪টি বিশেষ বই— ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পেসিস’, মার্ক্সের ‘পুঁজি’, মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ এবং স্পেনসারের ‘ফিলসফি অফ স্টাইল’।
এবার তিনি চেষ্টা চালান আলাস্কার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার। কিন্তু সময় ছিল বড্ড প্রতিকূল। পরিবারের জন্য বাধ্য হয়ে তিনি সব রকমের কায়িক পরিশ্রমের কাজ যোগাড়ের চেষ্টা করতে থাকেন অবিরত। অবশেষে স্থানীয় পোস্ট অফিসে ডাক পিয়নের কাজ যোগাড়ে সক্ষম হন।
বাড়তি উপার্জনের জন্য এক খবরের কাগজের জন্য গল্প লেখার চেষ্টা করতে থাকেন— যারা প্রতি হাজার শব্দের জন্য ১০ ডলার পারিশ্রমিক দিত। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে জ্যাক বাড়ির প্রায় সমস্ত কিছুই বন্দক রাখতে বাধ্য হন। কিন্তু এর মাঝে বিভিন্ন পত্রিকাতে তার লেখা পাঠাতে থাকেন, এক হিসেবে বলা যায় একজন সাহিত্যিক হিসেবে তার বুনিয়াদ এই সময়েই গড়ে ওঠে।
‘Overland Monthly’তে তার প্রথম গল্প ছাপা হল অবশেষে, কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুত ৫ ডলার তো ফেরৎ পাঠালই না এমনকি জ্যাককে পত্রিকাটির সৌজন্য সংখ্যা পর্যন্ত পাঠানো হল না! কিন্তু এরপরও একই পত্রিকায় কেবলমাত্র সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ‘The White Silence’- নামের গল্প পাঠালেন, লিখতেই থাকলেন দুই হাত ভরে।
১৯০০ সালে নতুন শতাব্দীতে প্রবেশকালে বেশ কিছু দিনের প্রেম ম্যাবেলকে ঘরে তুলেন। কিছুদিনের মধ্যই জ্যাকের উপার্জন গিয়ে দাঁড়াল প্রতিমাসে দেড়শ ডলার— সম্পূর্ণটাই লেখনীর মাধ্যমে! এই পরিমাণ অর্থ মাস ছয় আগেও ছিল পুরো পরিবারের কাছে স্বপ্ন বিশেষ।
যদিও সংসারে দুই কন্যা সন্তানের আগমনের পরেও ১৯০৪ সালে এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং পরের বছরই জ্যাক তার জীবনের সেরা প্রেম চার্মিয়ানকে বিয়ে করেন— যার সাথে পরবর্তীতে রয়েছে তার অসংখ্য ভ্রমণ এবং অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা।
বাড়তেই থাকে লেখক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা। আন্তর্জাতিক ভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সুনাম। ১৯০২ সালের শেষের দিকে জ্যাকের মাথায় কুকুর নিয়ে এক গল্প খেলে যায়, এটিকে পাতায় আঁকার চেষ্টা করেন তিনি ৪০০০ শব্দে এবং এর পরপরই তিনি বিমূঢ় হয়ে আবিষ্কার করেন গল্পটি কেবল মাত্র শুরু হয়েছে।
প্রথম বারের মতো বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক বুঝতে পারেন কিছু কিছু সময় আসে যখন গল্পই হয়ে দাঁড়ায় মূল চালক, সেক্ষেত্রে লেখককে গল্পের দাস হিসেবে তার মর্জিমত চলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। গল্পটির নাম তিনি দেন- ‘দ্য কল অফ দ্য ওয়াইল্ড’!
এর পরপরই ‘The Spray’ নামের এক ক্ষুদে স্কুনার কিনে ফেলেন তিনি। কারণ ততক্ষণে তার উর্বর মস্তিস্কে এসে গেছে সমুদ্র যাত্রা নিয়ে এক বিশাল উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা। এই সময়ে পায়ের নিচে জলের কম্পন অনুভব করতে চাইছিলেন জ্যাক। যখনই বাড়ীতে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়ে যেত, চলার মতো খাবার নিয়ে নিয়ে একা জাহাজে ভেসে দুরে চলে যেতেন, লোনা বাতাসে দেহ-মন জুড়িয়ে মত্ত থাকতেন সেই উপন্যাস রচনায়- যার নাম দিয়েছিলেন ‘সী উলফ’ (সাগর নেকড়ে)। বিশ্ব সাহিত্য অন্যতম অবিস্মরণীয় চরিত্র ক্যাপ্টেন লারসেনের আগমন ঘটল সাবেক নাবিকের কলম থেকেই! নিজের জমানো আর ধার করা টাকায় র্যাজেল-ড্যাজেল নামের এক পুরনো জাহাজ কিনে পুরোদস্তুর ঝিনুকদস্যু বনে যান জ্যাক। উপকূলীয় অঞ্চলে বেআইনি ভাবে ঝিনুক শিকার চলতে থাকে তার। এর ক’মাস পরেই সলিল সমাধি ঘটে তার সাধের জাহাজের।
১৯০৪ সালে নভেম্বরে উপন্যাসটি বাজারে আসার সাথে সাথেই ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। ছাপা হতে থাকে একের পর এক মুদ্রণ। বইটির আবেদন আজো অটুট। অনেক সমালোচকের মতে এটিই জ্যাক লন্ডনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
১৯১৬ সালের আজকের দিনে (২২ নভেম্বর) আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া শহরে মৃত্যুবরণ করেন।






















Be First to Comment