প্রবীর রায় : অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক : কলকাতা, ২০ জুন ২০২২। জাপানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোনও মন্দির নেই, মসজিদ নেই, রাত জেগে ওয়াজ নেই, নসিহত নেই, ধর্মীয় স্কলার নেই, মাজার নেই, ওরস নেই, পীর নেই, মুরিদ নেই, কুতুব নেই, তাবলীগ নেই, ঘন্টা পেটানো নেই, ধুপ ধূনো নেই, ফুল বেলপাতা নেই, দুধ ঢালা-জল ঢালা নেই! আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি বলেও কোনও বাগাড়ম্বর নেই। এগুলো ছাড়াই জাপান একটা সুশৃঙ্খল জাতি।
গত ত্রিশ বছরের মধ্যে কোনও দুর্নীতি নেই, কোনও ঘুষ নেই, কোনও ধর্ষণ নেই, স্কুলে কোনও ছাত্রকে বেত্রাঘাতের রেকর্ড নেই। কোনও কাজের জন্য কোনও ফাইল আটকে পড়ার নজির নেই। কারো সুপারিশ ছাড়া কোনও ছাত্র স্কুলে ভর্তি হতে পারছেনা, কারো প্রমোশন হচ্ছেনা- এমন দৃষ্টান্তও নেই। দলীয় ভাবে জাপানের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও শিক্ষকের নিয়োগের নজিরও নেই। রাস্তায় পড়ে থাকা বুভুক্ষু মানুষও নেই। আছে শুধু কর্মনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা।
ভূমিকম্পের সময় সব খাবার ক্যাম্পে রেখে দেওয়া হয়েছিলো। নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কেউ একটা রুটিও নিয়ে যায়নি। ত্রাণ কেন্দ্রে একজন প্রহরীকেও পাহারাদার রাখতে হয়নি। লাইন দাঁড়িয়ে সবাই যার যার মতো প্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে গেছে। লাইন দাঁড়ানো শেষ ছেলেটির হাতে খাবার প্যাকেট দেওয়ায় -সে সেই প্যাকেট আবার লাইনের সামনে রেখে এসেছে। যদি তার সামনে দাঁড়ানো কারো খাবার কম পড়ে যায়।
জাপানে কোনও কালো বাজারি দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে জিম্মি করেনা। কেউ খাবারে ভেজাল মেশায় না। রাস্তাঘাট গুলো এতো ঝকঝকে পরিষ্কার। নিজের চেহারা রাস্তায় দেখা যায়। শুধু বয়স্ক কিংবা যুবকরা না একজন শিশুও জাপানের রাস্তায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে রাখেনা। কোনও প্রোগ্রাম এক মিনিট দেরিতে শুরু হয় না। এক মিনিট ট্রেন লেট করেছিলো বলে – পত্রিকার পাতায় ক্ষমা চাওয়া হয়েছিলো।
টেকনোলজি আর ডেভেলপমেন্টে জাপান পৃথিবী থেকে দশ বছর এগিয়ে আছে। পুরো পৃথিবীর খাবার ফুরিয়ে গেলেও জাপানে আগামী ত্রিশ বছরের জন্য খাবার মজুদ আছে। বোমায় কয়লা হয়ে যাওয়া জাপান পুরো দুনিয়ার গাড়ীর বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অথচ, জাপানে ভার্চুয়ালি কোনও ন্যাচারাল রিসোর্স বলতে কিছুই নেই।
জাপানের মানুষের মাঝে আছে শুধু বিনয় আর বিনয়। আর ক্ষমা প্রার্থনা। অবসরে যাওয়া জাপানি প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন- কি করতে পেরেছি তার জন্য দয়া করে গুণ কীর্তন করবেন না। বরং যা করতে পারিনি সেটার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। দু হাত একসাথে করে- জনগণের সামনে মাথা নীচু করে (যেটা জাপানি কালচার) বারবার ক্ষমা চাচ্ছিলেন জাপানের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে।
ধর্মের দোষ দিচ্ছি না, মসজিদ কিংবা মন্দিরেরও না, মাজারেরও না। শুধু আত্ম-সমালোচনা করছি।
আমাদের মোড়ে মোড়ে এতো এতো মসজিদ, মন্দির, মাঠে মাঠে এতো ওয়াজ, গলিতে গলিতে এতো মাজার, শনি মন্দির, শিব মন্দিরের বাহুল্য হওয়ার পরও পরিবর্তন হচ্ছে না কেন? কেউ জবাবদিহি করার মতো জায়গায় আছেন কি…? ও মশাই….!!
(এক জাপান প্রবাসীর ডাইরি থেকে-)
পুনশ্চ: আর একটা কথা যুক্ত করা বোধহয় প্রয়োজন।
জাপানীদের এই উঁচু স্তরের সংস্কৃতির পেছনে একটা মস্ত বড় কারন রয়েছে! জাপানে ক্লাস ফোর পর্যন্ত কোনও হাম্পটি ডাম্পটি, বা লিটল লিটল টুইঙ্কল স্টার ধরনের কেতাবি পড়াশোনা হয়না। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেই শিশুদের লেলিয়ে দেওয়া হয়না, ‘বাবু , ওটা আঙ্কেলকে একটু শুনিয়ে দাও তো…!’ ওয়ান-টু-থ্রী, এমন কি, এ, বি, সি, ডি. পর্যন্তও নয়! শিশুদের এই সময়টাতে কেবলই সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়..! তাইই বোধহয় এরকম নয়, তাইই এমন!
সৌজন্যে – দেবিকা।
Be First to Comment