দেবাশিস বিশ্বাস : এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী, ১৬ আগস্ট, ২০২৪। ২৭ শে জুলাই, ২০২৪। বিমানে রওনা দিই কলকাতা থেকে, উদ্দেশ্য দিল্লি হয়ে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু। প্রথম দু একদিন আশপাশ ঘুরে নিলাম। ২রা আগস্ট, ২০২৪, শুক্রবার সকালবেলায় একটা মিনি ভ্যানে চেপে আমরা বেরিয়ে পড়লাম পর্বতাভিযানে। গন্তব্য বাকু থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের কুবা হয়ে আরও পঞ্চাশ কিলোমিটার এগিয়ে খিনালিগ গ্রাম। প্রথমে কাস্পিয়ান সাগরের পার ঘেঁষে উত্তরমুখী জাতীয় সড়ক পথে এগিয়ে এরপর সে পথ ছেড়ে বাঁদিকে ঘুরে পৌঁছলাম কুবা। খিনালিগে দলের তিনজনকে রেখে অভিযানের চার সদস্য এগিয়ে চললাম শাহদাগ (Shahdag) বেসক্যাম্পের দিকে।
খিনালিগের পর রাস্তা বলতে কিছুই নেই। পুরোপুরি ভাঙাচোরা একদম মাটির রাস্তা, মাঝে মাঝে নেমে যেতে হচ্ছে খরস্রোতা নদীর বুকে, কখনওবা পাহাড়ি ঘাসের ঢালের মাঝ দিয়ে পথ। পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো এক প্রাচীন জিপ আমাদের এক জায়গায় নামিয়ে দিল। সেখান থেকে শুরু হলো ট্রেকিং। সেদিনই আরো প্রায় ঘন্টা দেড়েক ট্রেক করে পৌঁছলাম সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় পৌঁছলাম শাহাদাগ বেসক্যাম্প (২,৮৫০ মিটার)। এদেশে সকালের আলো সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ফুটে গেলেও রাতে আটটা পর্যন্ত বেশ পরিস্কার আলো থাকে। ঠিক হলো সেদিনই গভীর রাতে রওনা দেব শাহদাগ শৃঙ্গ আরোহণের উদ্দেশ্যে।
শাহদাগ (৪,২৪৩ মিটার/১৪,০০২ ফুট), এলাকায় “পর্বতের রাজা” বলে খ্যাত, আজারবাইজানের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত সর্বোচ্চ পর্বত। এটি বৃহত্তর ককেশাস পর্বতমালার একটি শৃঙ্গ, যা আজারবাইজানের কুসার জেলায়, রাশিয়ার সীমানার কাছে অবস্থিত। ককেশাসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ রাশিয়ার এলব্রুস (৫,৬৪২ মিটার/ ১৮,৬১৯ ফুট)। আজারবাইজানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বাজারদুজু (৪,৪৬৬ মিটার/১৪,৭৩৮ ফুট), যা রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। শাহদাগ আরোহণ পর্বতারোহীদের জন্য একটি বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ।
৩রা আগস্ট ভোররাত সাড়ে তিনটেয় রওনা দিয়ে দুর্গম এই শাহাদাগ পর্বত শীর্ষে পৌঁছই সকাল ১১টা ১০ মিনিটে। আরোহন করি – মলয় মুখার্জি, অভিজিৎ রায়, কিরণ পাত্র ও আমি – দেবাশিস বিশ্বাস। প্রায় আধঘন্টা কাটাই শীর্ষে। তারপর কঠিন সেই পথ অতিক্রম করে বেস ক্যাম্পে নেমে আসি বিকেল চারটেয়।
এবার আমাদের লক্ষ্য আজারবাইজানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বাজারদুজু। পরদিন শাহাদাগ বেস ক্যাম্প গুটিয়ে নেমে আসি নিচে। সেখানে অপেক্ষা করছিল জিপ। সেই জিপ ফের পার্বত্য পথ পার করে আমাদের পৌঁছে দিল বাজারদুজু বেস ক্যাম্পের নিচের এক পাহাড়ি ঢালে। সেখান থেকে ঘন্টা দুয়েক ট্রেকিং শেষে পৌঁছই বাজারদুজু বেস ক্যাম্প (৩,১০০মিটার)।
বাজারদুজু পর্বত (৪,৪৬৬ মিটার/১৪,৬৫২ ফুট) বৃহত্তর ককেশাস পর্বতমালায় রাশিয়ার দাগেস্তান এবং আজারবাইজানের সীমানায় অবস্থিত। আজারবাইজানি ভাষায় বাজারদুজু শব্দের অর্থ “বাজারের চত্বর”, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে এটি একটি নির্দিষ্ট ল্যান্ডমার্ক হিসাবে “বাজারের দিকে বাঁক নাও”। মধ্যযুগে এই শৃঙ্গের পূর্ব দিকে অবস্থিত শাহনাবাদ উপত্যকায় বার্ষিক বৃহৎ বহুজাতিক মেলা অনুষ্ঠিত হতো বলে হয়ত এর এমন নাম।
বেলা আড়াইটা নাগাদ পৌঁছাই বেস ক্যাম্প। পরদিন, ৫ই আগস্ট, ভোর রাত তিনটেয় রওনা দিলাম শীর্ষারোহণের উদ্দেশ্যে। একটানা আরোহন শেষে সকাল ন’টার মধ্যে আমরা চারজনই পৌঁছে গেলাম বাজারদুজু শীর্ষে। ইচ্ছা ছিল বাজারদুজুর একদম পাশের শৃঙ্গ ‘জাফর” (Zafar) আরোহণের। কিন্তু অতিসম্প্রতি জাফর শৃঙ্গের মাথায় রাখা ফলক চুরি হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে কাউকে জাফর আরোহণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আমাদের সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে হলো। বেলা ১২:০০ টায় নেমে এলাম বেস ক্যাম্প। সেদিনই তাঁবু গুটিয়ে ট্রেকিং করে নিচে নেমে জিপ ধরে খিনালিগ হয়ে বাকু পৌঁছলাম ৬ তারিখ ভোররাত আড়াইটেয়।
এরপরের লক্ষ্য জর্জিয়ার ককেশাস পর্বতমালায় অভিযান। কিন্তু জর্জিয়া সরকার আমাদের সদস্য মলয়ের ভিসা বাতিল করে দেওয়ায় ও আমাদের সাথে যেতে পারল না। ৮ ই আগস্ট পৌঁছই জর্জিয়ার রাজধানী টিবিলিস। দশ তারিখ শুরু হয় অভিযান, এবারের লক্ষ্য জর্জিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় ও তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাজবেক (Kazbek, ৫০৫৪ মি), স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ মহৎ চরিত্র। টিবিলিস ছেড়ে আমরা পৌঁছাই ১৫০ কিমি উত্তরের স্টেপান্সমিন্ডা (১,৭০০ মি)। পরদিন শুরু হয় আমাদের ট্রেকিং। ১৭০০ মিটারের স্টেপান্সমিন্ডা থেকে আট ঘণ্টা ট্রেকিং করে উঠে যাই ৩৭০০ মিটার উচ্চতার বেথেলমে হাট বা মেট্রো স্টেশন। ১৩ তারিখ ভোররাত দুটোর সময় শুরু হয় শীর্ষ অভিযান। অবশেষে দীর্ঘ প্রায় ১০ ঘণ্টা নিরলস চলার পর, তীব্র হাওয়ার দাপট ও তুষার ঝাপটার মধ্যেই পৌঁছই কাজবেক শীর্ষে। আরোহন করি – অভিজিৎ রায়, কিরণ পাত্র ও আমি। সেদিনই মেট্রো স্টেশন নেমে আসি বিকাল ৫ টায়। এরপর ফেরা স্টেপান্সমিন্ডা হয়ে টিবিলিস।
অভিযান সম্পূর্ণ হল। সম্ভবত ভারতবর্ষ থেকে এ ধরনের অভিযান এই প্রথম। সফলভাবে আরোহন হলো জর্জিয়া ও আজারবাইজানের ককেশাস পর্বতমালার তিনটি শৃঙ্গ।
জর্জিয়া ও আজারবাইজানের ককেশাস পর্বতমালায় অভিযান….।
More from GeneralMore posts in General »
- ইউসিএমএএস আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ২০২৪: বিশ্ব মানসিক গণিত প্রতিভার এক অসাধারণ প্রদর্শনী….।
- Restaurateurs Serve Up Festive Cheer This Christmas: NRAI Santa’s Cause….
- Princeton Club Becomes the Heart of Festive Cheer this Christmas….
- তুমি বহুরূপে সেজে এসো হাসি মজা দিয়ে শুধু ভালোবেসো…।
- Sau Saal Pehle: Sonu Nigam’s Homage to Mohammed Rafi on His 100th Birth Anniversary….
- দীর্ঘ প্রতিক্ষিত “রোগ পরিচয় ” বইটি প্রকাশিত হল !….
Be First to Comment