সৌমী মজুমদার : কলকাতা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। আজকের দিনে সদ্য প্রয়াত গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে স্মৃতিচারণ লেখা খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সময়টা আজ থেকে নয় বছর আগে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত একাডেমির দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণে নির্বাচিত হলাম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্কলার হিসেবে। শেষ কিছু বছরের খেয়াল বিভাগে সফল প্রতিযোগীদের থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিলো ৪ জনকে। আমিও ছিলাম তারমধ্যে একজন, প্রশিক্ষক ছিলেন কসুর পাতিয়ালা ঘরানার খলিফা উস্তাদ রাজা আলী খান সাহেব (কিংবদন্তী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান সাহেবের পৌত্র তিনি)। এই সমস্ত কিছু যাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত, অর্থাৎ যাঁর তত্বাবধানে এই কর্মকাণ্ড, তিনি হলেন কিংবদন্তী শিল্পী, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তিনি নিজে দীর্ঘদিন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন, তাঁর ইচ্ছে ছিল নতুন প্রজন্মের আরো অনেকে উঠে আসুক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অঙ্গনে। আমারও এক নতুন যাত্রা শুরু হলো এখান থেকেই।
দীর্ঘদিন প্রচারের অন্তরালে থাকা এই শিল্পী যেদিন প্রথম এলেন আমাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের ক্লাসে, সেদিনের সমস্ত কিছু ছবির মত মনে পড়ে। আমায় উনি নাম জিজ্ঞেস করেন, আমি কেঁদেই চলেছি একভাবে, তখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা ঘটনাটি সত্যি ঘটছে কিনা আমার সাথে। আমার কন্ঠে গান শুনলেন। উস্তাদ জী গাওয়ালেন দু কলি ঠুমরী..উনি গান শুনে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন.. আমার কলেজে রসায়ন পড়ানোর কথা এবং রসায়ন নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছের কথা শুনলেন.. শেষে বললেন, “অনেক গুলো জন্মের পর আসে শিল্পী জন্ম, তোমার এই জন্ম শিল্পী জন্ম, ঈশ্বর যেটা দিয়েছেন সেটার কদর করো, তুমি গানটা করো মন দিয়ে”… গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এই কথা গুলো আমার জীবনের গতিপথ পাল্টে দিলো। এর পর কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি এই ভেবে যে, কতোটা সৌভাগ্য থাকলে এমন ঘটে কারো সাথে!.. এর পর বহুবার কখনো রাজ্য সঙ্গীত একাডেমির ক্লাসে, কখনো কোনো ক্লাসিক্যাল মিউজিক কনফারেন্সে ওনার সান্নিধ্য পেয়েছি… কতো প্রশ্ন করেছি ওনার সঙ্গীত শিক্ষা, সাধনা নিয়ে। কতো সুন্দর করে, কতো মমতায় উত্তর দিয়েছেন সব কিছুর.. গুরুর কাছে ওনার সঙ্গীত শিক্ষা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আসরে গাইবার আগে এবং লঘু সঙ্গীত বা ছায়াছবিতে গাইবার আগে ওনার ভিন্ন রেওয়াজ পদ্ধতির কথা, সমস্ত ধারার গান যে আলাদা আলাদা আকাশ, আলাদা মগ্নতা-সংযম- শিক্ষা- বোধ- মননশীলতা দাবী রাখে সেসব কথা জানতে পারি.. সঙ্গীত যে তাঁর কাছে পূজা সেটা অনুভব করলাম। এর পর এই কিংবদন্তী শিল্পী এবং আমার উস্তাদের আশীর্বাদে বেশ কিছু মর্যাদা পূর্ণ মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনার সৌভাগ্য লাভ করি। অনেক গুণী, স্বনামধন্য বিখ্যাত শিল্পীদের মাঝে এই নবাগতাও সুযোগ পায়। প্রথম টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের আগের দিন টেলিফোনে কতো পরামর্শ দিয়েছেন আমায়। যতবার দেখা হয়েছে, আমার গুরুর কথা জিজ্ঞেস করেছেন, আমার সঙ্গীত শিক্ষার খোঁজ নিয়েছেন, আরো কতো স্মৃতি! কিংবদন্তীর আশীর্বাদ সারা জীবনের পাথেয় , তাঁর সান্নিধ্য বড়ো অমূল্য আমার কাছে।
Be First to Comment