ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : ১৩ অক্টোবর ২০২১।সনাতন হিন্দু ধর্মে কুমারী রূপে মাতৃ আরাধনা সুপ্রাচীন ৷ ঋগ্বেদের দেবী সূক্তে , ত্রৈতেরীয় আরণ্যক , বিভিন্ন পুরাণ এবং মহাভারতের ভীষ্ম ও বিরাট পর্বে কুমারী পুজোর কথা আছে ৷ অর্জুন কুমারী পূজা করেছিলেন। ৷শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও রয়েছে কুমারীর উল্লেখ ৷ তবে , রামচন্দ্রের রাবণ বধের জন্য দেবগণ যজ্ঞের জন্য
ব্রহ্মার কাছে এলে তিনি দেবীর আদ্যাশক্তির স্তব করতে বলেন ৷ তখন দেবী আর্বিভূত হয়ে মর্ত্যে এক বেলগাছতলায় বোধন করতে পরামর্শ দেন ৷
ব্রহ্মা এসে দেখেন বেলগাছের পাতায় একটি ছোট
শিশু কন্যা নিদ্রিত আছেন ৷
সেই শিশু কুমারীকে পুজো করে তুষ্ট করে রাবণ বধের বর লাভ করেন ৷ মাতৃত্ব ও দেবুত্ব প্রতিটি মহিলার আজন্ম সম্পদ ৷
তাই আশ্বিনের শুক্ল অষ্টমী তিথিতে কোথাও
বা সপ্তমী বা নবমীতে দুর্গাপূজার অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে “কুমারী পূজা” ৷ কুমারী প্রকৃতি বা নারী
জাতির বীজাবস্থা ৷ তন্ত্র মতে ১ থেকে ১৬ বছরের আর দেবী ভাগবত অনুযায়ী ২ থেকে ১০ বছরের
অজাতপুষ্প বা অরজঃস্বলা বালিকাদের কুমারী রূপে পুজো করা হয় ৷ বয়স ভেদে কুমারীর একেক নাম ১বছরের সন্ধ্যা , সরস্বতী(২), ত্রিধামুক্তি(৩), কালিকা(৪),, সুভগা(৫), ঊমা(৬), মালিনী(৭), কুব্জিকা(৮), কালসর্ন্দভা(৯), অপরাজিতা (১০) (১১) ভৈরবী (১২), মহালক্ষ্মী(১৩) পীঠনায়িকা(১৪), ক্ষেত্রজ্ঞা(১৫) এবং অম্বিকা(১৬) ৷পাদ্য , অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, ফুল ও নৈবেদ্য দিয়ে ষোড়শোপচারে এই পুজো করা হয় ৷আমাদের ধর্মমতে ,সব স্ত্রীলোক মহামায়ার অংশ বা এক একটি বিশেষ রূপ ৷ আর শুদ্ধসত্ব কুমারীতে ভগবতী অধিক প্রকট ৷ কুমারী সরলতা, ভালোবাসা , নিরহঙ্কার ও মানবতার প্রতীক ৷ কুমারী শক্তি বিশ্ব প্রসবিনী ৷ঈশ্বরের ভাব অনন্ত , তাই যে কোন ভাব অবলম্বন করে ভগবানের আরাধনা করা যায় ৷ তাই , মাটি , পাথরের প্রতিমার বদলে চেতন কুমারীতে চৈতন্যময় ঈশ্বরের উপাসনা করা হয় ৷ কুমারী পুজোর মধ্যে দিয়ে আমরা জগন্মাতাকে নিজের করে নিয়ে তাঁর শরণাগত হওয়ার প্রয়াসী হই ৷ পুরাণে কুমারী রূপে দেবীর কোলাসুর বধের কথা আছে ৷ যোগিনীতন্ত্রে লেখা আছে ব্রহ্মার শাপে বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হলে তিনি হিমাচলে মহাকালীর আরাধনা ৷ দেবীর সন্তুষ্ট হলে বিষ্ণুর পদ্ম থেকে সহসা “কোলা” নামের এক মহাসুরের আবির্ভাব হয় ৷কুমারী রূপে মা কোলানগরী গিয়ে কোলাসুরকে হত্যা করেন ৷রামকৃষ্ণ মিশনের নানা কেন্দ্রে কুমারী পুজো ব্যাপকভাবে প্রচলিত ৷ রামকৃষ্ণ পরমহংস
ষোড়শী রূপে মা সারদার পুজো করেছিলেন ৷ স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৮ সালে কাশ্মীর ভ্রমণ কালে এক মুসলমান কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করেন ৷ ১৮৯৯ সালে কন্যাকুমারী গিয়ে স্বামীজী সেখানকার ডেপুটি একাউন্টেট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের মেয়েকে কুমারী রূপে পূজা করেছিলেন ৷ সারদা দেবীর উপস্থিতিতে স্বামী বিবেকানন্দ নিজে বেলুড় মঠে কুমারী পূজা করেছিলেন ৷ সেবার ১৯০১ সালে সেখানে ৯ জন কুমারীকে পুজো করা হয় ৷ বিবেকানন্দের চোখে সব কুমারীই দেবীর এক একটি রূপ ৷ এর দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন ! আসলে ব্রহ্মান্ডে সৃষ্টি , স্থিতি ও লয় এই ত্রিশক্তির ক্রিয়ার শক্তি বীজাকারে কুমারীতে নিহিত ৷সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে নারীকে ভোগ্যা রূপে নয় পূজ্যা রূপে দেখা হয়েছে ৷ এই সাধন পদ্ধতিতে বিশ্বজননী মহামায়া আদ্যাশক্তি কুমারী নারীমূর্তিতে সাধকের কাছে ধরা দিয়েছেন ৷বলা যেতে পারে এখনকার কুমারী পুজো তাঁরই অবদান ৷ মহাষ্টমী পূজার পর আবার কোথাও নবমী পূজার হোম যজ্ঞ শেষে নির্দিষ্ট কুমারী কন্যাকে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে ফুল ও গহনা দিয়ে সাজিয়ে পা ধুইয়ে কপালে তিলক এঁকে পুজোর নির্দিষ্ট বেদী বা আসনে বসিয়ে পূজার নৈবেদ্য দিয়ে পুজো করা হয় ৷ এতে বোঝা যায় হিন্দু ধর্মে নারীকে কতখানি মহান মর্যাদায় বসিয়ে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা হয় ৷নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে মাতৃরূপে সম্মান জানানো এর লক্ষ্য ৷এর ফলে মন হয় চৈতন্যযুক্ত তথা কলুষতামুক্ত ৷ মেরুতন্ত্রে বলা হয়েছে ,” সব কামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা , যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা , ধনলাভের জন্য বৈশ্যকন্যা এবং পুত্র লাভের জন্য শুদ্রকন্যা কুমারী রূপে পূজা করতে ৷ তাই মহাদেব যোগিনী শাস্ত্রে বলেছেন ,”শত কোটি জিহ্বায় কুমারী পূজার ফল বলতে পারবো না ৷দেবী পুরাণে বলা হয়েছে শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ ৷
গত ২০১৯ সালে বেলুড়ে ৫ বছর ৯ মাস ৬ দিন বয়সী আরাধ্যা ভট্টাচার্যকে “সুভাগা” রূপে পুজো করা হয়েছিল ৷
ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে পূজিত হয়েছিল প্রিয়তা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের একটি ছোট্ট মেয়ে ৷দৈনিক ইত্তেফাক অফিসের কাছে রামকৃষ্ণ মিশনে অনেকবার এই অনুষ্ঠান দেখেছি ৷ এবারে কোভিড পরিস্থিতি ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজা বন্ধ ৷ বেলুড় মঠে হলেও তা দর্শক দেখতে পারছেন না ৷ দুর্গা পুজোয় বেশী হলেও কালী , জগদ্ধাত্রী ও অন্নপূর্ণা পূজাতেও অনেক জায়গায় কুমারী পূজা হয় ৷মাদুরাইয়ের মীণাক্ষী আম্মান মন্দিরে , আসামের কামাখ্যা মন্দিরে ও কন্যাকুমারী মন্দিরে ধূমধাম করে কুমারী পূজা হয় ৷আসুন আমরা সবাই বলি – ” মা তুমি ত্রৈলোক্যসুন্দরী , কিন্তু তুমি আজ সুভাগা ( যে বয়সী কুমারী পূজিত হবেন সেই নামে) রূপে আমার সম্মুখে উপস্থিত ৷ তুমি জ্ঞানরূপিনী , হাস্য
ময়ী ও মঙ্গলদায়িনী ৷” আমি তোমাকে প্রণাম করি৷
Be First to Comment