” শুভ বড়দিন ” ( HAPPY X -MAS)!
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১। আজকের দিনে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পালিত হয় সবচেয়ে বড় উৎসব “বড় দিন” ! মনে করা হয় এই দিন জন্মেছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের প্রর্বতক “যীশু খ্রিস্ট ” ৷
যিনি পৃথিবীর বৃহত্তম (সবচেয়ে বেশী এলাকায় বিস্তৃত , প্রায় ৩২% মানুষের ধর্ম) খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা৷ অন্যদের কাছেও একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ৷
গ্রিক ভাষায় খ্রিস্টোস ( Christos ) মানে ত্রাণ
কর্তা বা মুক্তিদাতা ৷ অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস এক খ্রিস্টাব্দে (ওনার নামেই এই সাল ) র ২৫ ডিসেম্বর
আর অন্যমতে ৪ খ্রিস্টাব্দে “কানান” বা আজকের
“প্যালেসস্টাইনে”র জেরুজালেম (ঈশ্বরের নগরী বা শান্তির শহর) এর কাছে বেথেলহেমে এক ঘোড়ার আস্তাবলে তাঁর জন্ম ৷ প্যালেসস্টাইনের গ্যালিলি রাজ্যের নাজারেথ নগরীর রাজা ডেভিডের ৪১ তম উত্তরসুরী যোশেফ ও মেরি ( মিরিয়াম) র পুত্র যীশু ৷ বলা হয় পুরুষ সর্ম্পক ছাড়া কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে ঈশ্বর পুত্র যীশুর পবিত্র জন্ম ( Emaculate birth ) ! ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রভু যীশু কে পশুর জাবনা (গামলা)য় তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয় ৷
প্রাচ্যের কয়েক জন দৈবজ্ঞ পন্ডিত জ্যোতিষ তারা দেখে যীশুর জন্মস্থানে এসে নবজাতক ও তাঁর মাকে সোনা , গুগ্ গুল ও আতর দিয়ে প্রণাম করে যান ৷ আর বলেন ইনি ইহুদিদের রাজা ৷ যীশু নামটাও তাঁরা দেন ৷ যীশু শিষ্যদের আরিমায়িক (Aramic) ভাষায় নীতিগল্প (Parable ) দিতেন ৷ শেষ সান্ধ্য ভোজ (Last supper) এর সময় শিষ্য জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতায় ইহুদি বিচারসভা বা স্যানিড্রিনে রোমান শাসকের নির্দেশে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় ৷ জেরুজালেম শহরের বাইরে
গলগোথায় (মানে মাথার খুলি / ল্যাটিনে calvarious) তাঁকে ক্রুশে চড়ানো হয় , জঘন্য অপরাধীদের পাশে ৷ কবর দেওয়া হয় ইহুদিদের অপবিত্র গোরস্থানে ৷ পরে তাঁর পুনরুথ্থান ( Resurrection ) হয় ৷ তাঁর জীবতকালে তাঁর জীবনী লেখা হয় নি ৷ ৭০ থেকে ১১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গ্রিস, ইটালি , মিশর ও এশিয়া মাইনরে বসে যথাক্রমে মার্ক , ম্যাথু , লুক ও জন চার জন যিশু
সংক্রান্ত সুসমাচার (Gospel) লেখেন ৷ যা তাঁর শিষ্যদের কাছে শুনে লেখা ৷ চীন, জাপান, নেপাল , সৌদী আরব ,ইরান , তুরস্ক ও উত্তর কোরিয়া ছাড়া অধিকাংশ দেশে যীশুর জন্মদিন হিসাবে ২৫ ডিসেম্বর ছুটি থাকে ৷ যদিও, তাঁর জন্মদিনের সঠিক তথ্য নেই ৷ ঐতিহাসিক রোমান উৎসব বা উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবসই পরে যীশুর জন্মদিন ধরা হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষকদের ধারনা ৷
তবে, রাশিয়া , ইউক্রেন , সার্বিয়া , জর্জিয়া , আর্মেনিয়া , মিশরের মত কতিপয় দেশে ৭ জানুয়ারি যীশুর জন্মদিন বা বড়দিন পালিত হয় ৷
আবার এশিয়া মাইনরের দেশগুলিতে ৬ জানুয়ারি
যীশুর দীক্ষাস্নান / ব্যাপ্টিজমের দিনকে বড়দিন
বা তাঁর জন্মদিন মনে করা হয় ৷ দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত কোন খ্রিস্টীয় উৎসবের তালিকায় বড়দিন
ছিল না ৷ ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমে “স্যাটার্নানিয়া ” উৎসব হতো ৷ যা পরবর্তীতে বড়দিন উৎসবে পরিণত
হয় বলে মনে করা হয় ৷ খ্রিস্টানরা এদিন মুক্তি ও
আনন্দের উৎসব রূপে গ্রহণ করে ৷ ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে
রোমান ক্যালেন্ডারে প্রথম ২৫ ডিসেম্বরকে যীশুর
জন্মদিনের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ৷ তবে , ৪৪০ সালে
পোপের অনুমোদনে এটা মান্যতা পায় ৷ ক্রিসমাস
বানান গ্রিক ভাষায় christor এটা ‘c’ নয় গ্রীক ভাষায় “কাই ” x সেজন্য লেখা হয় HAPPY X
MAS । এক সময় বড়দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিল গ্রিটিংস কার্ড ৷ ১৮৬০ সালে ইংল্যান্ডে গ্রিটিংস কার্ড চালু হয় ৷ এখন আমরা প্রায় সবাই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অভিবাদন জানাই ৷
আমাদের দেশে ১৬৬৮ সালে প্রথম বড়দিন পালনের খবর পাওয়া যায় ৷ কেক , সান্তাক্লজ ,খ্রিস্টমাস ট্রি , নাচ গান , পান ভোজন পরে আসে ৷ কলকাতায় ইংরেজদের বড়দিনের মহাভোজে থাকত শুয়োরের মাথা (বোরস হেড) যা রোজমেরি, বে লিফ (তেজপাতা) , আপেল ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশিত হত ৷ টার্কি, ডাক রোস্ট, পুডিং, প্লাম এসব খাওয়া হতো৷ ঘরে ঘরে তৈরী হতো ওয়াইন ৷
প্রধান ভোজ হতো বড়লাটের প্রাসাদে ৷ দেশি খ্রিস্ট
ভক্তরা বৈষ্ণবদের মতো খোল করতাল বাজিয়ে খ্রিস্ট কীর্তন করতেন ৷ তখনকার কলকাতা –
” খ্রীস্টের জনমদিন , বড়দিন নাম ৷
বহুসুখে পরিপূর্ণ , কলিকাতা ধাম ৷”
কেরানী দেওয়ান আদি বড় বড় মেট ৷
সাহেবের ঘরে ঘরে পাঠাইতেছে ভেট ৷
ভেটকী কমলা আদি , মিছরি বাদাম ৷
ভালো দেখে কিনে লয় , দিয়ে ভালো দাম ৷”
এই সময়কালে বড়দিনের অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে “সান্তাক্লজ” ৷ বড়দিনকে মনে করা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্মের স্থপতি যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন বলে ৷
পঁচিশ তারিখের আগের অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর রাতে উপহারের ঝোলা নিয়ে সান্তাক্লজ ছোটদের কাছে হাজির হন ৷লাল জোব্বা পরা সাদা দাড়িওয়ালা মানুষটির পুরো নাম সেন্ট নিকোলাস ৷ যদিও সান্টা , সেন্ট নিক , ক্রিস ক্রিঙ্গল ও ফাদার ক্রিসমাসও তাঁকে বলা হয় ৷ দু হাজার বছর আগে তিনি তুরস্কে থাকতেন ৷ ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তুরস্কের মায়রা নগরীতে তাঁর জন্ম ৷ ৩৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ এই গ্রিক বিশপের মৃত্যু হয় ৷ তবে , আমেরিকানরা বলেন তিনি উত্তর মেরুর কাছে থাকেন ৷ ডাকে তাঁকে চিঠিও পাঠানো যায় ৷ তাঁর স্ত্রী মানে শ্রীমতী ক্লজ , নিজের স্লেজ গাড়ি ও তার বাহক আট নটি বলগা হরিণ এবং জাদুকরী ক্ষমতার এলফদের নিয়ে সান্তা থাকেন ৷ ক্রিসমাস ইভের আগের রাতে তিনি জোব্বার পকেটে ভরে শিশুদের জন্য নানারকম উপহার নিয়ে হাজির হন ৷ শান্ত , মিষ্টি ছেলেমেয়েরা বালিশের তলায় ঘুম থেকে এসব পেয়ে আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠে ৷
তবে , দুষ্ট ছেলেমেয়েদের ভালো কিছু জোটে না ৷ তারা পায় কয়লা ৷ ১৮২২ সালে ক্লেমেন্ট ক্লার্ক মুর ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে সান্টাকে নিয়ে কবিতা লেখেন৷ উনবিংশ শতাব্দিতে কার্টুনিস্ট নাস্ট সান্তার বর্তমান রূপ দেন ৷ X – বা গ্রিক ভাষায় চি বলতে আমরা ক্রিসমাস বুঝি ৷ মনে করা হয় খ্রিস্টান হওয়ার আগে থেকে শীতে সবুজ গাছের ডাল দিয়ে বাড়ী সাজাতো রোমানরা ৷ পরে বিভিন্ন খ্রিস্টিয় দেশে নানা রকম গাছপালা দিয়ে “ক্রিসমাস ট্রির” প্রচলন হয় ৷ অনেকে বলেন প্রোটেস্টান মতের প্রবক্তা মার্টিন লুথারের হাত ধরে শুরু হয়েছে ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন। সেই সালটা ১৮৩৫ ৷ ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস ট্রি শুরু করেন তৃতীয় জর্জের রানি শার্লোট ৷ মহারানি ভিক্টোরিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রিটিশ উপনিবেশ গুলিতে ছড়ায় ৷ এই গাছ লাগানো হয় সান্তাকে স্বাগত জানাতে ৷
কমলালেবু ও কেক হয়ে দাঁড়ায় বড়দিনের অন্যতম অঙ্গ।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস লর্ড পিয়েরপন্ট রচনা করেন সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের অন্যতম “জিঙ্গল বেল”৷ যা সারা পৃথিবীতে এই সময় সবচেয়ে বেশি গাওয়া হয় ৷ ইতালিতে রান্না হয় ” বাকালা ” নামের নোনতা মাছ ৷ ইউক্রেনবাসীরা বাড়ীতে এই সময় মাকড়সার ঝুলকে পয়মন্ত ভাবেন ৷ অস্ট্রেলিয়া , নিউজিল্যান্ডে প্রচন্ড গরমে পালিত হয় বড়দিন ৷ সেখানে সান্তা আসার জন্য রাতে বাড়ীতে ঢোকার পথ রাখা হয় ! এই করোনাকালেও সান্তা সবার জন্য খুশি বয়ে আনুক৷ হিংসা মুক্ত হোক এই বিশ্ব। নিউজ স্টারডম এর পক্ষ থেকে আবারও সবাইকে বড়দিনের অভিনন্দন জানাই ৷
Be First to Comment