প্রান্তিক সেন : কলকাতা, ২৩ জুন ২০২২। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, জুটিটা ভেঙেছে। এভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে, কল্পনায় আসেনি। সাংবাদিক রাহুল গোস্বামী যে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে, এখনও মানতে পারছি না। ত্রয়ীর মধ্যে পড়ে রইলাম আমি আর ইমনকল্যাণ। আশির দশকে যেমন কলকাতা ময়দান থেকে কৃশাণু হারিয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনটাই মনে হচ্ছে রাহুলদার অবর্তমানে।
ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের হাল শক্ত হাতে ধরেছিল সেই ২০০৯ সালে। সেই থেকে টানা ১৩ বছর একটানা নেতৃত্ব দিয়েছে ক্লাবকে। কখনও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে, কখনও সহ সম্পাদক হিসেবে, আবার কখনও সহ সভাপতি হিসেবে।
সেই দিনটা মনে আছে, যেদিন সরল সেনকে চোখের সামনে চলে যেতে দেখলাম। তাঁর শবদেহের সামনে দাঁড়িয়ে রাহুলদা আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিল, ক্লাবের কী হবে এবার! সরলদাই তো অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে ক্লাবের সেতুবন্ধের কাজ করতেন।
এবার হয়তো, তোকে আর আমাকেই সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। ২০০৭ সাল তখন। তারপর থেকেই আমাদের দু’জনের নিয়মিত যাতায়াত ২৬ নম্বর জওহরলাল নেহরু রোডের ৬ তলার ঘরে।
১৯৯৫ সাল থেকে সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছি রাহুলদার সঙ্গে। শেষের আট বছর দু’জনের অফিস আলাদা হলেও ক্লাবে দেখা হতো নিয়মিত। ২০১১ সাল, তৎকালীন সভাপতি হিমাংশু চট্টোপাধ্যায় এসে যখন আমাকে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব দেন, তাতে মূল ইন্ধন ছিল রাহুলদার। পরে টের পেয়েছি সেটা।
ততদিনে ক্লাবের নাড়ি-নক্ষত্র জেনে গিয়েছি, আমরা দু’জন। সেইবার রাহুলদার সহ সম্পাদক পদে দ্বিতীয় টার্ম। ক্লাব পরিচালনায় ইমনকল্যাণ সেনের পদার্পণ সেই বছর। এরপর অজান্তেই একটা কম্বিনেশন গড়ে উঠেছিল তিনজনের মধ্যে। ভাবনায় কখনও অমিল, কখনও নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও হয়েছে। কিন্তু দিনের শেষে আবার একসুরে কথা বলেছি রাহুলদা, ইমন আর আমি। এই শিক্ষার বীজই ক্লাব সদস্যদের মধ্যে বুনে দিয়ে গিয়েছে রাহুলদা।

২০১৫ সাল, এবার সাধারণ সম্পাদকের কুর্সিতে রাহুলদা। হিমাংশুদা তখন সভাপতি। আমি কমিটিতে আমন্ত্রিত সদস্য। হিমাংশুদা, রাহুলদা এবং কর্মসমিতির তৎকালীন সদস্যদের রায় মেনেই আমাকে সহ সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়। তবে কাজের চাপ কমার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাউকে না বলেই হিমাংশুদা চলে গেলেন চির ঘুমের দেশে। সেই থেকেই সভাপতির দায়িত্ব চেপে বসেছে আমার উপর। সেই কঠিন পরিস্থিতিকে কীভাবে সামলাতে হয়, সেই শিক্ষা রাহুলদাই দিয়ে গিয়েছে। আর্থিক সঙ্কট থেকে সাংগঠনিক দুর্বলতাকে একা হাতেই কার্যত সামলেছে দূরদর্শী রাহুলদা।
সেই সময় আমি, ইমন আর রাহুলদা প্রায় প্রতিদিনই আলোচনা করেছি কীভাবে সচল রাখা যায় ক্লাবকে। পাশে পেয়েছি শম্ভুপ্রসাদ সেন, রথীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম গোস্বামীর মতো সিনিয়রদের। তাঁদের পরামর্শ আমাদের ত্রয়ীকে পথ চলতে উদ্বুদ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। এই পর্বেই আমরা মুখোমুখি হয়েছি করোনার। প্রায় বছর দু’য়েক কোনও কর্মসূচি পালন করা যায়নি। আর কর্মসূচি না থাকলে ক্লাবের আয়ের পথে বাধা তৈরি হয়। ইমন আর রাহুলদার পরিকল্পনায় সেই সঙ্কটকে কাটিয়ে উঠেছে ক্লাব। সেই পরিকল্পনার সুনিপুণ রূপায়নে ক্লাবের তিন কর্মীর (সহকর্মী বলাই ভালো) ক্লান্তিহীন চেষ্টা ঢাকা দিয়েছে সব কিছুকে।

২০২১ সালে ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভা থেকে ইমন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরার পর সহ সভাপতির দায়িত্ব বর্তায় রাহুলদার উপর। ক্লাব জীবনের গোটা পর্বে জুনিয়রদের সঙ্গে নিয়ে কীভাবে পথ চলতে হয়, কীভাবে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়াতে হয়, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছে রাহুলদা। একইসঙ্গে সিনিয়রদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষার গুরুদায়িত্বও পালন করেছে রাহুলদা। শুধু ক্লাব নয়, আশা করি এই শিক্ষা জীবনের প্রতি মুহূর্তে কাজে লাগবে আমাদের, যারা রয়ে গেলাম এই পৃথিবীতে।
রাহুলদা, বেশি তাড়াতাড়ি চলে গেলে তুমি। ক্যান্সারকে জয় করে আসার মুহূর্তেই ত্রয়ীর জুটি ভেঙে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলে। নিশ্চিন্তে ঘুমোও তুমি। আমরা জেগে আছি, পাহারাদার হিসেবে। থাকতেই হবে। তোমার পরিকল্পনাকে রূপায়ণের চেষ্টা চলতে থাকবে।
সামনের রবিবার (২৬/০৬/২০২২) ক্লাবের ৪৪ তম বার্ষিক সাধারণ সভা। দীর্ঘ ২৫-২৬ বছর বাদে এই প্রথম তোমাকে ছাড়া এই সভা করতে হবে আমাদের। এই বেদনা রাখব কোথায়? এই সভাই হয়ে উঠবে তোমাকে স্মরণের সর্বশ্রেষ্ঠ মঞ্চ। আমি নিশ্চিত, তোমার আলো ছড়ানো পথকে দৃষ্টান্ত করেই এগিয়ে চলবে ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাব। সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যাবে রবিবার বার্ষিক সাধারণ সভায়।
স্যালুট রাহুলদা।
Be First to Comment