#বাংলা চলচ্চিত্রে অভিজাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। ১৯০০ সালে আজকের দিনে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।#
প্রবীর রায়: অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক, ১৩ জুলাই, ২০২০। আজকাল বাংলা ছবি দেখতে গিয়ে প্রায়ই নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়। বিদেশি কোনো সাধারণ ছবির সঙ্গে যখনই মোটামুটি একটা তুলনামুলক আলোচনা করে দেখেছি, তখনই মনে হয়েছে ছবির ভিতর সব থেকেও কি যেন নেই। বিগত কুড়ি বছরে বাংলা ছবির পরিবর্তন হয়েছে অনেক। টেকনিকের দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে এসেছে আমাদের ছবি। বাইরে থেকে সম্মানও কুড়িয়েছে বেশ কয়েকটি, কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে একটা প্রশ্নই মনে আসে, তা হচ্ছে টেকনিকের সঙ্গে ছবির মান উন্নত হচ্ছে কি? টেকনিকের উন্নতিই যদি ছবির মানকে উন্নত করতে সক্ষম হতো, তবে আজ এই কুড়ি বছরের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের (বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলতে আমি বোঝাচ্ছি revolutionary process বা দ্রুত পরিবর্তনকে) পরেও কোন ছবি দেখতে গেলে মনে হয় নিতান্ত জোলো আর নয়তো চড়া মেলোড্রামার সুরে বাঁধা? মনে রাখতে হবে টেকনিক কিছুটা উন্নত হয়েছে। তা হলে অভাবটা কিসের? এক কথায় এর একটা মাত্র উত্তরই মনে পড়ে সেটা হচ্ছে অভিনয়ের। তাই যদি না হবে, তাহলে অভিনয় জগত থেকে যাঁরা চলে গেছেন চিরতরে, তাঁদের replacement হচ্ছে না কেন? নাটকের ক্ষেত্রে আজকাল de-dramatised কথাটা খুব চালু হয়েছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও কি তেমন de-acting এর প্রয়োজন? তাই যদি হয় তবে সেই এলেম কোথায়? ইদানিং কয়েকজন অভিনেতা যাঁরা স্টেজে অভিনয় করে সহস্র দর্শকদের হৃদয়মন জয় করেছেন, নাটকের ক্ষেত্রে এনেছেন অভাবনীয় পরিবর্তন, তাঁরাই যখন স্ক্রিনে এসেছেন, সেখানে তাঁদের সেই জ্বলন্ত প্রতিভা যেন মূহুর্তে ম্লান হয়ে গেছে। বহুমুখী অভিনয়ের প্রতিভা একটা যেন বিশেষ টাইপ-এ পর্যবসিত হয়েছে।সেদিক থেকে দেখতে গেলে যার কথা আজ সব থেকে বেশী মনে পড়ে, যাঁর অকালমৃত্যু বাংলা ছবির জগতকে একান্ত পঙ্গু করে দিয়েছে, রঙ্গমঞ্চকে ঠেলে দিয়েছে গভীর অন্ধকারে , তাঁর নাম ছবি বিশ্বাস……..। কি যাত্রায় (নিমাই সন্ন্যাস), কি রঙ্গমঞ্চে, কি পর্দায় – সর্বত্র ছবিদা ছিলেন এক জ্বলন্ত প্রতিভা। যতো দিন যাচ্ছিল উত্তোরোত্তর সে শিখা যেন আরও লেলিহান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল চতুর্দিকে। আজকের দিনে কোথায় সেই প্রতিভা? আর অভিনয় প্রতিভা ছাড়া শুধুমাত্র টেকনিকের উন্নতি দিয়ে ছবির মান উন্নত করবার স্বপ্ন…. কাঁচের আকরে পদ্মরাগ মণির জন্ম দেবার মতোই অসম্ভব।
আমি যখন দর্শক, তখন “প্রতিশ্রুতি” ছবিতে ছবিদার অভিনয় দেখেই বুঝে ছিলাম যে এ হচ্ছে জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড। কোনও দিনও বোধহয় অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিয়ে আলাদা কিছু ভাবিনি, কিন্তু ” প্রতিশ্রুতি” র ছবি বিশ্বাস আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিলো আর তখন থেকেই বুঝে ছিলাম অভিনয়ই হচ্ছে ছবিদার প্রাণ। আর অভিনয় জীবন্ত না হলে ছবি হবে মৃতদেহবৎ। “কার পাপে?” ছবির শুটিং এর সময় ওঁর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বুঝলাম যে অভিনয় আর চরিত্র সৃষ্টি কি জিনিস? বহু ছবি করেছি বহু শিল্পীর সঙ্গে কিন্তু ছবিদার মতো ওই রকম প্যাশন আর কারো মধ্যে দেখিনি। কি প্রচণ্ড সংবেদনশীল মন। লজ্জাবতী লতাকে ছুঁয়ে দিলে তারও বোধহয় পাতা বন্ধ হতে সময় নেয় কিন্তু চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে ছবিদার সেই সময়টুকুরও প্রয়োজন হতো না। মুহূর্তের মধ্যে তিনি অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। শুধু কি তাই? কি প্রচণ্ড screen personality ছিলো তাঁর। ওই একটি মাত্র লোক স্ক্রিনে থাকলে যেন তাঁর পর্বতপ্রমান গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের পাশে আশেপাশের আর সব কিছু নস্যাৎ হয়ে যেতো। বেশিদিনের কথা নয়, ” শুন বরনারী” দেখতে গিয়ে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে ছিলাম– চারু ঘোষের অভিনয় দেখি না হোমিও হিমুর অভিনয় দেখি। নিজের অভিনয়ের প্রতি প্রত্যেক শিল্পীরই বোধহয় একটা উদ্বেগপূর্ণ মমত্ববোধ থাকে। কিন্তু ছবিদা যতোক্ষণ আমার কাছাকাছি ছিলেন, আমি একবারও বোধহয় নিজের দিকে তাকাইনি। বরং বলা ভালো ছবিদার অভিনয় আমাকে অন্য কোনো দিকে বিন্দুমাত্র চোখ ফেরাবার সুযোগ দেয়নি। এই প্রচণ্ড screen personality একমাত্র ছবিদা ছাড়া অন্য কারও আছে কি না (কিংবা ছিলো কি না), আমার জানা নেই।
যে কোনো ধরনের চরিত্র, তা যতো কঠিনই হোক না কেন, ছবিদার কাছে যেন তা রসোত্তীর্ণ করা ছিলো অতি সহজ কাজ। কাঁচকে কাটতে গেলে প্রয়োজন হয় হীরের আর হীরেকে কাটতে হীরেরই প্রয়োজন। এর আর অন্য কোনো বিকল্প নেই। তাই ছবি বিশ্বাসের জুড়ি একমাত্র ছবিদাই।
ছবি বিশ্বাস সম্পর্কে প্রথম এবং শেষ একটি মাত্র কথাই প্রযোজ্য — তা হচ্ছে … ন ভূতো ন ভবিষ্যতি। অমনটি ছিলোও না, আর হবেও না কোনোদিন ……….
( দুজনে বড়ো পর্দায় মুখোমুখি ৪০ টি ছবিতে)
——————————————————-।
[ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন- “জলসাঘর”, “কাঞ্চনজঙ্ঘা” ও “দেবী” ছবিতে। তাঁর অভিনয় যে ছবির মান বহুগুণ বাড়িয়ে তুলত তা বহুবার স্বীকার করেছেন খোদ সত্যজিৎ রায়।বলিউডে অভিনয়ের একাধিক প্রস্তাব পেলেও বারবার তা ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। রাজ কাপুর #একদিন_রাত্রে সিনেমার শুটিংয়ের জন্য ছবি বিশ্বাসকে মুম্বই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তিনি রাজি হননি। এরপর কলকাতায় পুরো ইউনিট এনে ছবি বিশ্বাসের অংশটুকু শুটিং করে নিয়ে যান রাজ কাপুর।]
Be First to Comment