জন্মদিনে স্মরণঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
বাবলু ভট্টাচার্য : ১৮টি ভাষা যাঁর দখলে, যে ভাষায় উনি কথা থেকে শুরু করে লিখতে পর্যন্ত পারেন, রাশিয়ান ভাষায় ‘প্রেম’ উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট, বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক, আল-আজহারে পড়াশুনা, তুলনাত্নক ধর্মচর্চা যাঁর নখদর্পনে, গীতা যাঁর সম্পূর্ণ মুখস্ত আর রবীন্দ্রনাথের গীতিবিতান টপ টু বটম ঠোঁঠস্থ তাঁকে যদি ‘পণ্ডিত’ বলা হয় তাহলে কি আপত্তি থাকতে পারে?
তবে ‘সব কিছু যে পণ্ড করে তিনিই পণ্ডিত’ এটা অবশ্য সৈয়দ মুজতবা আলী নিজেই বলেছেন।
আজন্ম জ্ঞানপিপাসু মননশীল সাহিত্যধারার অন্যতম স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত সাহিত্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ মুজতবা আলী।
ঐতিহ্য বহনকারী ব্যক্তিত্ব খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দর আলী (১৮৬৫-১৯৩৯) ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলীর পিতা। আর মা আয়তুন মান্নান খাতুন ছিলেন বাহাদুরপুর পরগনার জমিদার মহসীন চৌধুরীর কন্যা।
সৈয়দ মুজতবা আলী শিল্প-সাহিত্য ও রূপে-গুণে ছিলেন সব্যসাচী। আড্ডাপ্রিয়, ‘মনস্বী ও মজলিসি’ সৈয়দ আলীর ডাকনাম ছিল ‘সিতা’ বা ‘সিতারা’। সাহিত্য এবং লেখালেখির জগতে তাঁর রয়েছে অনেক ছদ্মনাম। বাংলা সাহিত্যে বোধ হয় আর অন্য কোন লেখক এত ছদ্মনাম ব্যবহার করেননি। সেগুলো হচ্ছে— সত্যপীর, টেকচাঁদ, রায় পিথৌরা, সিতু মিঞা, ওমর খৈয়াম, বিষ্ণু শর্মা, দারাশিকো, গোলাম মৌলা, প্রিয়দর্শী।
১৯১৫ সালে সিলেটের মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন সৈয়দ মুজতবা আলী। পরে সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ১৯১৯ সালে তাঁর জীবনে নতুন পথের সঞ্চার হয়। সঞ্চালক ছিলেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই সময়কালে রবীন্দ্রনাথ সিলেট পরিভ্রমণকালে মুরারিচাঁদ কলেজে ‘আকাঙ্ক্ষা’ বিষয়ক বক্তৃতা করেন। ওই অনুষ্ঠানে ড. আলী ছিলেন নীরব একনিষ্ঠ শ্রোতা। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা মুজতবার মনে গভীর উন্মাদনার সঞ্চার করে। ‘আকাঙ্ক্ষা’ কিভাবে বড় করতে হয়, সেই বিষয়ে একটি চিঠিও লেখেন রবি ঠাকুর বরাবর শান্তিনিকেতনের বারান্দায়। জবাবটাও পেলেন শিগগিরই। অনুসন্ধিৎসু মুজতবা আলী চলে গেলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ শান্তিনিকেতনে, ১৯২১ সালে।
স্বয়ং কবিগুরুর সান্নিধ্যে তিনি পাণ্ডিত্য লাভ করলেন বিদেশি ভাষায়। পাঁচ বছর শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার পর বিশ্বভারতীয় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন। ওই সময়ে তিনি সংস্কৃতি, হিন্দি, গুজরাটি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় পারদর্শী হন। ১৯২৭ সালে বিশ্বভারতীর প্রথম সমাবর্তন উৎসবে স্নাতকের সনদপত্র অর্জন করেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ১৯২৭-১৯২৯ সালে মুজতবা আলী কাবুল সরকারের শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক নির্বাচিত হন।
বহুমাত্রিক বিরল প্রতিভার অধিকারী প্রাতিস্বিক চেতনার প্রাগ্রসর মনীষী সৈয়দ মুজতবা আলী নান্দনিক শিল্পমাত্রায় ছিলেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার। তাঁর কথনবিশ্ব এবং মজলিসি সাহিত্যকৃতির দূরদর্শিতার পুরস্কারস্বরূপ ওই সময়কালে (১৯২৯-১৯৩২) জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী ‘হুমবলট’ বৃত্তি পেয়ে জার্মানিতে যান। প্রথমে বার্লিন, পরে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ভূগোল, দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সর্বোপরি সাহিত্য-শিল্পের সব শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল সমান তালে।
সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বইপড়ুয়া এবং ভ্রমণপাগল। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে তাঁর পঞ্চতন্ত্রের (১৯৫২) ‘বই কেনা’ প্রবন্ধে। সৈয়দ মুজতবা আলী কোন বিষয় নিয়ে লেখেননি— সব বিষয়েই বাগ্বৈদগ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন।
তাঁর সর্বমোট প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৯টি। তাঁর চারটি মৌলিক উপন্যাস : ‘অবিশ্বাস্য’, ‘শবনম’, ‘শহরইয়ার’ ও ‘তুলনাহীনা’।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি নরসিংহ দাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে ২০০৫-এ তাঁকে একুশে পদক-এ ভূষিত করা হয়।
আদ্যোপান্ত রবীন্দ্রভক্ত সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সোমবার, বেলা ১১টায় ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় আজিমপুরে ভাষা শহীদ বরকত ও সালামের পাশে।
সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ সালের আজকের দিনে (১৩ সেপ্টেম্বর) সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment