Press "Enter" to skip to content

উস্তাদ রশিদ খানের গুণমুগ্ধ ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর স্বয়ং। ফুটবল খেলাতেই তার বেশি ঝোঁক ছিল, শুধু খেয়াল নয়, তারানাতেও তিনি অনবদ্য…………

Spread the love

————শুভ জন্মদিন উস্তাদ রশিদ খান———-

বাবলু ভট্টাচার্য : ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন শাস্ত্রীয় সংগীতের কিংবদন্তীগণ। তাদের তৈরি সুরের মূর্ছনায় বিশ্ব আলোড়িত হয়েছে। মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে তারা থেকে গেছেন চিরভাস্বর হয়ে। সেরকম একজন সংগীতজ্ঞ, শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ও খেয়াল গায়ক হলেন উস্তাদ রশিদ খান। উত্তর প্রদেশে বরেলীর কাছে এক বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার শাকিল বাদাঁয়ুর নামে রয়েছে বাদাঁয়ু নামে একটি গ্রাম। এই গ্রামেই উস্তাদ রশিদ খান জন্ম নেন। তার পিতা হামিজ রেজা খান ছিলেন সংগীতজ্ঞ আর মা শাখরী বেগম ছিলেন গৃহিণী। রশিদ খান যে পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস ও তাৎপর্য বিবেচনায় সেই পরিবারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই পরিবারেই জন্ম নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীরা। শুধু তা-ই নয়, তাদের নিজস্ব সঙ্গীত ঘরানা ছিল।

“রামপুর-সহসওয়ান” নামের এই বিখ্যাত ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আরেক বরেণ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ এনায়েত হুসেন খান। রশিদ খানের চাচা উস্তাদ গোলাম মুস্তফা খানও সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাই ছোটবেলাতে পরিবার থেকেই তার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়। প্রথমে বাবা হামিজ রেজা খানের কাছে এবং পরবর্তীতে দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবের কাছে তার প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা সম্পন্ন হয়। ছোটবেলাতে তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল আর দুরন্ত প্রকৃতির। গানের নিয়মিত চর্চার চেয়ে ফুটবল খেলাতেই ছিল তার বেশি মনোযোগ। কিন্তু তার দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কঠোর নিয়মকানুন আর অনুশাসনে নিয়মিত চর্চা করতে হত তার। মাত্র এগার বছর বয়সে রশিদ খান মঞ্চে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপরের বছর ১৯৭৮ সালে দিল্লীতে আই টি সি সঙ্গীত সম্মেলনে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং অতি অল্প বয়সেই তার সঙ্গীত গায়কী সকলকে আকৃষ্ট করে। ১৯৮০ সালে তিনি দাদুর হাত ধরে কলকাতা আই টি সি সঙ্গীত একাডেমিতে আসেন এবং এখানেই তার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে তিনি পরিপূর্ণ সঙ্গীতশিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।ছোটবেলা থেকেই অভাবনীয় পারদর্শিতা আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়নে মেধার দ্যুতিময়তার কারণে বহু বিখ্যাত ও প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞের আশীর্বাদ লাভ করেন তিনি। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী মুক্তকণ্ঠে তাকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাতে দ্বিধাবোধ করেন নি। পাশাপাশি উস্তাদ রশিদ খানের গুণমুগ্ধ ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর স্বয়ং। গায়কী বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে উস্তাদ রশিদ খান একজন অনন্যসাধারণ শিল্পী।

তিনি মূলত রামপুর সহসওয়ান ঘরানার হলেও ঘরানাকেন্দ্রিকতা কখনোই তাকে আটকে রাখেনি। তাই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার চমৎকারিত্ব তার কণ্ঠে মিলে মিশে ধারণ করেছে এক মোহনীয় রূপ। উস্তাদ রশিদ খান বিলম্বিত খেয়াল গায়নে তার দাদুর কাছ থেকে শেখা ব্যতিক্রমধর্মী গায়কীর সাথে সরগম ও সরগম তানকারীর মিশেল ঘটিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার প্রতিভার চমৎকারিত্ব প্রদর্শন করেছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ইন্দোর ঘরানার প্রবাদপুরুষ উস্তাদ আমির খাঁ ও শাস্ত্রীয় সংগীতের আরেক প্রাণপুরুষ পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গায়কীতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তার গায়কীতে এই দুই মহারথীর প্রভাবও সুস্পষ্ট। শুধু খেয়াল নয়, তারানাতেও তিনি তার অনবদ্য পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেছেন। দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন থেকে প্রাপ্ত তারানা গায়নে অনন্য শৈলীকে তিনি নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত করার মাধ্যমে তিনি তার পরিবেশিত প্রতিটি তারানাকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অন্য উচ্চতায়। তার গায়কীর আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের চলন অনুযায়ী কঠোর নিয়মের বাঁধনে আবদ্ধ করে সুরকে নিয়ে শুধু খেলাই করেন না, পাশাপাশি বন্দিশ কিংবা আলাপের সময় আবেগের স্নিগ্ধ স্পর্শ দিয়েও সঙ্গীতকে স্পর্শ করেন। সঙ্গীতে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি সঙ্গীত নাটক একাডেমি সম্মাননা, গ্লোবাল ইন্ডিয়া মিউজিক সম্মাননা, মহা সঙ্গীত সম্মান পদক সহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। শুধুমাত্র সঙ্গীতে এই অসাধারণ সাফল্যেই তিনি থেমে থাকেননি। তিনি নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন শাখরী বেগম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি স্বপ্ন দেখেন এক সঙ্গীত গ্রাম তৈরির। যেখানে সকলে সঙ্গীতের উদার বাণীতে দীক্ষা নেবে।

সঙ্গীতের জাদুকর এই মানুষটি আজও বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গিয়ে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলাদেশে এসেছেন বেশ কয়েকবার। প্রতি বছর ঢাকায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবে যোগ দিতেও তিনি আসেন।

ওস্তাদ রশীদ খান ১৯৬৮ সালের আজকের দিনে (১ জুলাই) উত্তরপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.