#সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকলেও সেচ্ছায় রক্তদান নিয়ে আরো প্রচার দরকার#
মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ১৪ জুন, ২০২০। নেতাজী দেশের যুবসমাজের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,” তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। ” সেই আহ্বান ছিল দেশ মাতৃকা কে ব্রিটিশ শাষন মুক্ত স্বাধীন রূপে স্থাপন করার জন্য। আর আজকে, স্বাধীন ভারতে রক্তদান করতে হচ্ছে মৃতপ্রায় জীবন কে প্রান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুসারে, রক্তদান হলো কোনও সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেবার প্রক্রিয়া। এই দান করা রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয় অথবা, অংশিকরনের মাধ্যমে ঔষধে পরিনত করে। আজ ১৪ই জুলাই, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। বিশ্বজুড়েই সারা বছর ধরে রক্তের অভাব লেগেই থাকে সেই প্রয়োজন মেটাতে স্বেচ্ছা রক্তদান প্রয়োজন।
আমাদের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে চাই প্রচুর রক্তের যোগান। সেটা একমাত্র সম্ভব সুস্থ দেশবাসীর নিজের রক্তদানের মধ্যে দিয়ে। উন্নত দেশে বেশিরভাগ রক্তদাতা হলেন, স্বেচ্ছা রক্তদাতা, দরিদ্র দেশ গুলো তে এই ধরনের প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যা খুবই কম। এখন প্রশ্ন রক্ত কেন এত জরুরি? রক্তের প্রধান দুটি উপাদান হলো রক্তকোষ ও রক্তরস। লোহিত রক্তকণিকা য় থাকে হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ যা দেহের বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে। তাই হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে। হিমোগ্লোবিন নানা ভাবে কমতে পারে যেমন, ক্যান্সার রোগী, হিমোফিলিয়া, থ্যালাসেমিয়া, আ্যনিমিয়া, এছাড়াও, সমস্ত হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজনে রক্ত মজুত রাখতেই হয়, জরুরি অস্ত্রোপচার, মারাত্মক দুর্ঘটনা, রক্ত পাত যুক্ত আঘাত, আগুনে পোড়া, গর্ভবতী র সংকটে, ইত্যাদি সময়ে রোগী কে বাঁচাতে একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক আছে যেখান থেকে আমরা রোগীর প্রয়োজন অনুসারে রক্ত কিনতে পারি। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত রক্ত দান শিবির থেকে প্রয়োজনীয় রক্ত যোগাড় করা হয়। এইজন্য সারাবছর ধরেই যাতে শহরে, মফস্বলে, প্রত্যন্ত গ্ৰামে সুস্থ মানুষজন রক্ত দান করতে এগিয়ে আসেন, তার জন্য সরকারিভাবে, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও রক্ত দাতাদের উৎসাহ দিয়ে থাকে। রক্ত কেন দান করবো, এর সমর্থনে পথনাটক, গান, ছড়া প্রচার করা হয়। যাতে জরুরি কালীন পরিস্থিতি কে অনায়াসে নিয়ন্ত্রনে আনা যায়। একজন সুস্থ পূর্নবয়স্ক পুরুষের শরীরে প্রতি কেজি তে ৭৭মিলিলিটার এবং একজন সুস্থ সবল মহিলার শরীরে প্রতি কেজি তে ৬৬ মিলিলিটার রক্ত প্রবাহিত হয়।
উভয়ের দেহে ই দৈনন্দিন কার্যক্রমের জন্য প্রতি কেজি তে প্রায়, ৫০ মিলিলিটার রক্ত সংবাহিত হওয়া প্রয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রতি পূর্নবয়স্ক সুস্থ পুরুষ তার প্রতি কেজি দৈহিক ওজনে ২৭ মিলিলিটার এবং সুস্থ মহিলা তার প্রতি কেজি দৈহিক ওজনে ১৬ মিলিলিটার নিজেদের স্বাভাবিক প্রয়োজনে র অতিরিক্ত রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছেন। একজন মানুষ অনায়াসে নিজ ওজনে র প্রতি কেজিতে ৮ মিলিলিটার করে রক্ত স্বেচ্ছায় দান করতে পারেন। তবে রক্ত দাতার দৈহিক ওজন নূন্যতম ৪৫ কেজি হতে হবে। তাহলে সহজেই ৩৬০ মিলিলিটার রক্তদান করা সম্ভব। একজন সুস্থ ব্যক্তি প্রতি তিনমাস অন্তর এই রক্ত দান করতেই পারেন। এতে আপনার শরীরের লোহিত রক্তকণিকা প্রানবন্ততা বাড়িয়ে তুলবে, কারন রক্ত দানের দুই সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রক্তকণিকার জন্ম হয়। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা স্ব ইচ্ছায় নিয়মিত রক্ত দান করেন কিন্তু আবার এমন অনেকেই আছেন যারা রক্তদানে ভয় পান। অনেকের মাথায় দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খায় এই ভেবে যে রক্ত দিতে গিয়ে কোনও বিপদ হবে না তো? উত্তর দৃঢ় ভাবেই আসে “না”। একদমই বিপদের সম্ভাবনা নেই। রক্ত সংগ্রহ করতে যে সকল জিনিসের প্রয়োজন হয় তার সবটাই জীবাণু মুক্ত এবং একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। এক ইউনিট রক্ত দান করতে সময় লাগে খুব বেশি হলে ১০থেকে ১৫মিনিট। রক্ত দাতাদের রক্ত আবার ঠিক জায়গা মতো পৌঁছায় চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে। এমনিতে ই আমাদের লোহিত রক্তকণিকা মোটে ১২০দিন বাঁচে। রক্ত দানের পর রক্তের কোষগুলো র ঘাটতি কয়েক সপ্তাহর মধ্যে পূরন হয়ে যায়। তবুও মুমূর্ষু কে রক্ত দেওয়ার সময় ব্লাড ব্যাংক বলে রক্ত নেই, এই কথা শোনার পর নিজেদের খুবই হতাশ এবং লজ্জা বোধ হয়। পরিশেষে বলতে হয়, কবে, কখন, কার কোথায় যে রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়বে, সে কথা কেউ জানে না।
সমাজে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা-দাত্রীর ঊজ্জ্বল উপস্থিতি প্রত্যেকেরই আপদে বিপদে, রক্তের প্রয়োজনে নিশ্চয়তা, নির্ভরতা আসে। এই সর্বজনীন সামাজিক বীমা প্রকল্পের অধীনে সকল সমাজ অন্তর্ভুক্ত মানুষকে অংশগ্রহণ করতে হবেই। তবেই এই দিন পালনের সার্থকতা হবে। নিয়মিত যারা রক্ত দান করে থাকেন তাঁরা অসময়ে, আপৎকালীন সংকটে যাতে কেউ বিপর্যস্ত না হয়, তার আগাম ব্যবস্থা করে থাকেন। অবশ্যই এরা সমাজের শ্রদ্ধার পাত্র, বিষম পরিস্থিতির বন্ধু।
Be First to Comment