Press "Enter" to skip to content

পুজোর ঢাক (The Drum)…।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ৪ অক্টোবর, ২০২৫। ” ঢাকের তালে কোমর দোলে , খুশীতে নাচে মন৷ বাজা কাঁসর জমা আসর ….. বলো দুর্গা মাঈকী !”
মন্ডপে মন্ডপে শিশু -কিশোর -যুবারা কোমর দোলাচ্ছে ৷ ঢাক , দুর্গা পুজো ও চৈত্র সংক্রান্তির গাজনের অপরিহার্য অঙ্গ ৷ ঢাকের “বোল” তোলা বেশ কঠিন ও অভ্যাস সাপেক্ষ ৷ মা দুর্গার বোধনে , ঘুম ভাঙাতে , পুজোর সময় , আরতী কালে ও বিসর্জনে ঢাকের বোল বিভিন্ন হয় ৷ আমাদের ছেলেবেলায় পঞ্চমীতে ঢাকে কাঠি পড়লে মন মেতে উঠত ৷ আর যখন বাজতো “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন ” মন ভারাক্রান্ত হয়ে যেত৷ দেশের ঢাকীদের বিশ্বাস ঢাকের “বোল” স্বয়ং শিবের সৃষ্টি৷ আমরা জানি পৃথিবীর প্রথম ব্যাকরণ বিদ পাণিনি তাঁর বৈদিক সংস্কৃতকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে “অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ ” রচনা করেন ৷ আজও দেখা যায় সংস্কৃত ব্যাকরণ সবচেয়ে বিজ্ঞান সম্মত ৷ পাণিনি ব্যাকরণ রচনা করে আঠারো দিন ধরে মহাদেবের তপস্যা করেছিলেন ৷ তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট ভগবান নটরাজ হয়ে চোদ্দোবার ডঙ্কা বা ঢক্কা বা ঢাক বাজান ৷ প্রতিবার ঢাকের বাদ্যে এক একটি নতুন শব্দ তৈরী হয় ৷ প্রতিটা শব্দ বিভিন্ন বর্ণের সমষ্টি ৷ এ থেকে পাণিনি তৈরী করেন চোদ্দটি সূত্র ৷ যা মহেশ্বর বা শিব সূত্র বলে পরচিত ৷ এটাই পাণিনি ব্যাকরণের মূল তত্ত্ব ৷ মহেশ্বরের নাচের দ্বারা তৈরী শব্দগুলিই ঢাকের বোল ৷আমার লেখা “হিন্দু ধর্ম ” এবং “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” বইদুটি পড়লে হিন্দু ধর্ম , ঐতিহ্য , সংস্কার , পূজাপদ্ধতি , ধর্মগ্রন্থ সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন ৷ মানুষের বিশ্বাস গাজনে ঢাক বাজালে নতুন বছরে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয় ৷ ঝড়ের তান্ডব কম হয় ৷ সমুদ্র গুপ্তের আমলে ফা হিয়েন এদেশে এসে বাংলাকে সঙ্গীত -নৃত্যের দেশ বলে উল্লেখ করেছিলেন ৷ময়নামতী বিহারের ছবিতে ডঙ্কা বা ঢাক বাদনরত মানুষ দেখা যায় ৷ মালদহের গম্ভীরায় ” ঢাক” নিয়ে প্রবাদ , ” গাজনের নাই ঠিক ঠিকানা / ডাক দিয়ে কয় ঢাক বাজানা “৷ কিংবা , বাংলাদেশে নববর্ষ বরণের অঙ্গ ঢাক
” বাজেরে বাজে ঢোল আর ঢাক , এসেছে পহেলা
বৈশাখ ” ৷ সেও শেষ ৷ এখন ঢাক শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন
পুজো – পার্বণে ৷ তবু , ঢাক ঢোলের তালে তালে , গ্রাম বাংলার গান আর বৈঠার ছন্দে মেতে ওঠে আমার মন ! ঢাকের সঙ্গে বাঙালী সংস্কৃতির সম্পর্ক বহুকালের ৷ ঢাক আত্মার আত্মীয় ৷ ইতিহাস বলে , ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই
জুলাই মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে সুব -এ – বাংলা অর্থাৎ তৎকালীন বাংলা প্রদেশের রাজধানী করলে সুবেদারের ইচ্ছায় ঢাকায় “ঢাক ” বাজানো হয়েছিল ৷ ঢাক হলো পারকাশান ইন্সট্রুমেন্ট ৷ চামড়া দিয়ে ঢাকা ৷ ঢোল , তবলা ও মৃদঙ্গের মত ৷ আম গাছের গুঁড়ি দিয়ে ঢাকের খোল তৈরী হয় ৷ কাঠে যাতে ঘুণ না ধরে তাই গোমূত্র , তেল , লঙ্কা , গোলমরিচ খোলে মাখানো হয় ৷ বাঁশের ছিলা আস্তে আস্তে বেঁকিয়ে তৈরী করা হয় চাক ৷কাঁচা চামড়ায় লবণ ছিটিয়ে ভিজিয়ে রাখতে ৷ চামড়ার উঠে গেলে কাজে লাগানো হয় ৷ছাগলের চামড়া শুকিয়ে কাটা চামড়ায় জল দিয়ে নিংড়ে নরম করে চাক বাঁধতে হয় ৷ বাঁধার পর চামড়া টান করা হয় ও ঝামা ঘষা হয় ৷ ঢাক ছাওয়ার আগে লক্ষ্মীর পা এঁকে , ধূপ ধূনো , গঙ্গার জল দিয়ে জায়গাটিকে পবিত্র করেন ৷ হাতুড়ি মেরে মেরে ঢাকের স্কেল ঠিক করা হয় ৷ যেদিকটা বাজানো হয় না সেদিকে ভেরেন্ডার বীজ বেঁটে লাগিয়ে স্বর গম্ভীর করা হয় ৷
একবার পুজোর আগে বাংলাদেশে গিয়ে বন্ধুদের কথামত গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী সদরের পুরান বাজারে ৷ ৫০০ বছরের পুরানো ” ঢাক – ঢোলের মেলা ” দেখতে ৷ প্রচুর ঢাকি ও ঢাক ৷ মনে হয় পুজোর আগের শিয়ালদহ স্টেশনকে ৷বাবা -দাদুকে গুরু মেনে গ্রাম বাংলার নানা স্থানের ঢাকিরা পুজোর আগে তালিম নেয় ৷ দিল্লী এশিয়াডে অংশ নেওয়া কল্যাণগড় নট্ট পাড়ায় অমূল্যচন্দ্র নন্দীর নামে ঢাক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরী হয়েছে ৷ বাংলার বিখ্যাত ঢাকি – গোকুল দাস , লালু দাস , ধণপতি দাস , মন্মথ দাসের নাম ঢাক মোদীরা সবাই জানেন ৷এঁদের অনেকে বিদেশেও বাজিয়েছেন ৷ পেশাদার পার্কশনিষ্টদের মত কয়েকজনের ঢাক বাদন সি.ডি . সহ সামাজিক মাধ্যমেও জনপ্রিয় ৷ছেলেবেলায় ঢাকের তালে নাচের স্মৃতি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে কয়েকটি বাংলাব্যান্ড ৷ জি -বাংলায় প্রথম মহিলাদের ঢাক বাজাতে দেখা যায় ৷এখন মছলন্দপুরের মেয়েদের দেখাদেখি বিভিন্ন স্থানে মহিলারা ঢাক বাজানোয় পুরুষদের একাধিপত্য খর্ব করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলার গর্ব ঢাককে ! “ঢাক” জাতীয় বাদ্য যন্ত্র পৃথিবীর নানা দেশে দেখা যায় ৷ তবে , চৈনিক ইতিহাসে ও পুরাতত্ত্বে তিন হাজার বছর ধরে ঢাকের ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে ৷ সেখানে অপেরা , কথাশিল্প , নাচ গান , জনসমাবেশ , বিভিন্ন প্রতিযোগিতা , নৌকা বাইচ ইত্যাদিতে নানা প্রকারের ও আকৃতির ঢাক বাজানো হত ৷ সেখানে মাঝখানটা মোটা দু প্রান্ত সরু পশু চামড়া দিয়ে ঢাকা একটু ছোট আকারের ঢাকের এক পাশে দুটো রিং লাগানো থাকে ৷ এর বাজনা বেশ সুরেলা মধুর ৷ অভিনয় ও নাচের সময় শিল্পীরা কোমরে হাত রেখে দু হাতে হাতল ধরে বাজান ৷ এছাড়া সেখানে থুং ঢাক , হোয়া ফেন ঢাক ও জয় ঢাক জাতীয় বড় ঢাক আজও বাজানো হয় ৷ জয়তু ঢাক , জয় জয় ঢাক ৷
“ঢাকের বাদ্য , শঙ্খ ধ্বনি
ছড়িয়ে দিতে শান্তির বাণী ,
বছর শেষে আবার এলো
মা দুর্গার আগমনী ,
মুছে যাক জরা – ব্যধি,
মুছে যাক গ্লানি
শুদ্ধ হোক , সুন্দর হোক
জগতের সকল প্রাণী ৷৷”

More from InternationalMore posts in International »
More from MusicMore posts in Music »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.